দেশে ফ্যাসিস্টদের স্থান হবে না: রিজভী

শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশে ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারের দোসরদের স্থান হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেছেন, শহীদদের রক্ত কোনোভাবেই বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। ফ্যাসিস্টদের ও তাদের সব দোসরের বিচার দেশের মাটিতেই হবে।

আজ রোববার বেলা আড়াইটার দিকে বিয়ানীবাজার উপজেলা সদর ও বারইগ্রাম বাজারে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ আয়োজিত পৃথক দুটি পথসভায় রুহুল কবির রিজভী এসব কথা বলেন।

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘বিগত ফ্যাসিস্ট শাসনের সময় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা হয়েছে, হামলা হয়েছে। আমাদের নেতা-কর্মীদের গণগ্রেপ্তার, গুম ও খুন করা হয়েছে। তারপরও বিএনপির একজন নেতা-কর্মীকেও লক্ষ্য থেকে তারা সরাতে পারেনি। দলের প্রত্যেক নেতা-কর্মী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে লড়াইয়ে কাজ করে গেছেন।’ তিনি আরও বলেন, দেশের গণতন্ত্র, বাক্‌স্বাধীনতা, ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য দলের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। সর্বশেষ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চূড়ান্ত লড়াইয়ে অনেক প্রাণ গেছে। এত শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশে ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারের দোসরদের স্থান হবে না।

এ সময় সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে চূড়ান্ত লড়াইয়ে সিলেট জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণ দিয়েছেন গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলার মানুষ। শহীদদের এই রক্ত কিছুতেই বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। দীর্ঘদিন থেকে এই এলাকার মানুষ উন্নয়নে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। জনগণের রায়ে বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে এই বঞ্চনা আর থাকবে না।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন আমরা বিএনপি পরিবারের আহ্বায়ক আতিকুর রহমান, কাতার বিএনপির সভাপতি শরীফুল হক প্রমুখ।




ইরান কী ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, ইসরায়েল সেগুলো মোকাবিলা করল কীভাবে

ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ইরানের প্রায় ১৮০টি উচ্চগতির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ইঙ্গিত দেয় যে তেহরান গত মঙ্গলবার রাতের হামলায় গুরুতর ক্ষয়ক্ষতি করতে চেয়েছে। সেদিক দিয়ে গত এপ্রিলে চালানো ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার চেয়ে এবারের হামলা ছিল ভিন্ন।

উচ্চগতির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যভ্রষ্ট করা ছিল চ্যালেঞ্জিং। তবে প্রাথমিক তথ্যমতে, হামলায় ইসরায়েলে কারও প্রাণহানি না হওয়া এবং পশ্চিম তীরে মাত্র একজনের প্রাণহানির বিষয়টি একে সামরিক ব্যর্থতার বিষয়টিও তুলে ধরে। যদিও ইরানের ছোড়া কিছু ক্ষেপণাস্ত্র এবং সেগুলোর অংশবিশেষ ভূমিতে আঘাত হেনেছে।

এ বছর এর আগে ব্যবহার করা ইরানের ইমাদ ও গদর ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের গতির ছয় গুণ গতিসম্পন্ন। এগুলো ইরান থেকে ইসরায়েলে পৌঁছাতে ১২ মিনিট সময় নেয়। এই গতি ঘণ্টায় ৪ হাজার ৬০০ মাইলের বেশি। সেখানে ইরান বলেছে, এবার তারা আরও দ্রুতগতির হাইপারসনিক ফাত্তে–২ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। যেগুলোর সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ১০ হাজার মাইল।

আড়াই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের করা হিসাবে ইরানের হাতে আনুমানিক তিন হাজার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছিল। সংগত কারণেই বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেশি হবে। তেহরান এসব ক্ষেপণাস্ত্রের বড় অংশই রেখে দিতে চেয়েছে, ইসরায়েল সংকট বাড়িয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করলে সে সময় ব্যবহার করার জন্য।

মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এত বেশিসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। এ ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা খুবই অত্যাধুনিক। আকাশেই ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ধ্বংস করতে সেখান থেকে যেসব ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়, সেগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এসব ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত কতটা, তা–ও নিশ্চিত নয়।

ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যভ্রষ্ট করার জন্য সাধারণত দূরপাল্লার ইউএস–ইসরায়েলি অ্যারো ৩ ও অ্যারো ২ ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা প্রথম ব্যবহার করা হয় ইসরায়েল–হামাস যুদ্ধে। এ ব্যবস্থার সঙ্গে মাঝারি পাল্লার ডেভিড স্লিং প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও সক্রিয় করা হয়। তুলনামূলক বেশি পরিচিত আয়রন ডোম প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় করা হয় স্বল্পপাল্লার সমরাস্ত্র ধ্বংস করার ক্ষেত্রে, প্রায়ই গাজা থেকে হামাস যেসব রকেট নিক্ষেপ করে, সেগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে।

গত এপ্রিলে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর চিফ অব স্টাফের অর্থ উপদেষ্টা বলেছিলেন, অ্যারো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা একবার সক্রিয় করলে ৩৫ লাখ ডলার ব্যয় হয়। আর ডেভিডর স্লিংয়ের ক্ষেত্রে এ ব্যয়ের পরিমাণ ১০ লাখ ডলার। ১০০ বা তার চেয়ে বেশিসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে কোটি কোটি ডলার ব্যয় হয়। যদিও ইরানের প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য ৮০ হাজার পাউন্ড বা তার চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হয়।

এবার ইরানের কতগুলো ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে আঘাত হেনেছে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গত এপ্রিলে ইরানের নিক্ষেপ করা ১২০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্য মাত্র ৯টি আঘাত হেনেছিল। তাতে দুটি বিমানঘাঁটিতে সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। সামরিক পরিভাষার ক্ষেত্রে, ওই হামলাও কার্যত ব্যর্থ হয়েছিল।

এপ্রিলে ইরান তিন শতাধিক ড্রোন এবং ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। তবে মঙ্গলবার তারা তুলনামূলক ধীরগতির ড্রোন ব্যবহার করে। এবার তারা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেনি বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

5




কারখানায় যেতে ভয় লাগে, বললেন প্রাণ গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী

শিল্পাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ‘আমরা কষ্টে আছি। আজকে আমার কারখানায় যেতে ভয় লাগে। ভয় লাগে এই জন্য যে আমি কী নিজের জীবন নিয়ে বের হয়ে আসতে পারব? এভাবে ব্যবসায়ীরা যদি নিজেদের কারখানায় যেতে শঙ্কিত হন, তাহলে তাঁরা আগামী দিনে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবেন না।’

বর্তমান পরিস্থিতিতে যাঁরা শিল্পাঞ্চলে অসন্তোষ উসকে দিচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান আহসান খান চৌধুরী। বলেন, ‘বর্তমানে যাঁরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতায় অন্যায় সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁদের শিক্ষা দিতে হবে। আমাদের দেশে কখনোই ‘‘দিতে হবে, দিতে হবে’’, ‘‘দাবি মানতে হবে’’—এমন সংস্কৃতি ছিল না। আমরা বিগত দিনে কারখানাগুলোতে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করেছি। আমরা সেই সংস্কৃতি ফিরে পেতে চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ব্যবসা পরিচালনার জন্য আইনশৃঙ্খলার উন্নতি একটি মৌলিক বিষয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে আগামী দিনে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।’

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব কথা বলেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ। এ সময় বক্তব্য দেন শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, মেট্রোপলিটন চেম্বারের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ, বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ।

সেমিনারে ব্যবসায়ী নেতারা ব্যবসায়ের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির ওপর জোর দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তাঁরা বলেন, বর্তমান সরকারকে ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা বাড়াতে হবে।

সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘ঠিক জায়গায় ঠিক লোক বসালে ভালো ফল দেয়। এই সরকারের আমলে সে প্রমাণ পাচ্ছি। ইতিমধ্যে ব্যাংকমাধ্যমে প্রবাসী আয় আসা বেড়েছে। বিনিময় হার অনেকটাই স্থিতিশীল হয়েছে। বর্তমান গভর্নরের ওপর ব্যবসায়ীদের আস্থা আছে। তবে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতায় আছে। গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়ায় শ্রম অসন্তোষের নামে দুর্বৃত্তায়ন চলছে। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির মধ্যে থাকলে নতুন কর্মসংস্থান কীভাবে হবে।’

ব্যাংক ঋণের সুদহার নিয়ে মেট্রো চেম্বারের সাবেক এই সভাপতি বলেন, ১৪-১৫ শতাংশ সুদ দিয়ে ব্যবসা করে বিশ্বের কোনো দেশে মুনাফা করা যায় না। ১৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করা ছোট বা বড় কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। অর্থায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। তিনি আরও বলেন, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বন্ধ। এফডিআই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ডলারের জন্য নয়, বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় যুক্ত হওয়া যায়। রপ্তানি পণ্যের বাড়তি দাম পাওয়া যায়। বর্তমানে যেসব বিদেশি প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান করলেই বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুলবে।

প্রশাসন পুরোপুরি কাজ করছে না, এমন দাবিও করেন সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, ‘প্রশাসন পুরোপুরি কাজ করছে না। চাকরি থাকবে কি থাকবে না, নতুন করে আবার কী বের হয়ে আসে—এমন সব কারণে কাজ করতে চাচ্ছেন না অনেকে। ফলে সরকারকে দৃঢ়তার সঙ্গে কর্মকর্তাদের বার্তা দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু প্রবাসী আয় এবং দাতাদের ঋণ ও সহায়তায় দেশ চলবে না। ব্যবসায়ীদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাঁদের (ব্যবসায়ীদের) কথা বলার একটা জায়গা লাগবে। সরকারকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘বর্তমান সরকার এখনো ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। ব্যবসায়ীদের কথা শুনতে হবে। তাঁদের অবদান স্বীকার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব অব্যবস্থাপনা ছিল, সেগুলো সংস্কার করতে হবে। তবে সেখানে এখনো কোনো উদ্যোগ দেখছি না।’

4



হিজবুল্লাহ-ইসরায়েলের শত্রুতা কত বছরের, কতবার মুখোমুখি তারা

গত বছরের অক্টোবরে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার পর থেকেই লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ও হামাসের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। দুই পক্ষই আন্তসীমান্ত হামলা চালাতে থাকে। সম্প্রতি সে উত্তেজনা চরমে রূপ নেয়। হিজবুল্লাহ নিশ্চিত করেছে, বৈরুতে আবাসিক ভবনে ইসরায়েলি বিমান হামলার ঘটনায় হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলের দাবি, গত শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) রাতে হিজবুল্লাহর সদর দপ্তরের ওপর চালানো হামলায় নাসরুল্লাহ নিহত হয়েছেন। শুক্রবার বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় দাহিয়েহ এলাকায় ব্যাপক বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর দক্ষিণ ফ্রন্টের কমান্ডার আলী কারাকিসহ আরও কয়েকজন কমান্ডারও নিহত হয়েছেন।

এরপর গতকাল মঙ্গলবার থেকে লেবাননে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাতের ঘটনা নতুন কিছু নয়। এ বৈরিতা প্রায় অর্ধ শতকের পুরোনো। এ সময়ের মধ্যে দুই পক্ষ বেশ কয়েকবারই লড়াইয়ে জড়িয়েছে।

১৯৮২ সালে লেবাননের হামলা

১৯৮২ সালে লেবাননে হামলা চালায় ইসরায়েল। লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল থেকে ইসরায়েলের ওপর প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) হামলার জবাবে ওই অভিযান শুরু হয়। তখন থেকে লেবাননে সাত বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলেছে।

ইসরায়েল চেয়েছিল তাদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ থাকবে, এমন একটি সরকার লেবাননের ক্ষমতায় আসুক। সে আশা নিয়ে ইসরায়েল লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল দখল করে নেয় এবং তারা বৈরুতের পশ্চিমাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বৈরুতের পশ্চিমাঞ্চলে ছিল পিএলওর মূল ঘাঁটি। ইসরায়েলি বাহিনী এলাকাটি অবরুদ্ধ করে ফেলে।

একটি সমঝোতা চুক্তির পর পিএলও তিউনিসিয়াতে সরে যায়। তবে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী লেবাননে থেকে যায়। তারা স্থানীয় সংগঠনগুলোকে গৃহযুদ্ধে সমর্থন জুগিয়ে যেতে থাকে। সাবরা ও শাতিলায় হত্যাকাণ্ডেও ইসরায়েলের ভূমিকা ছিল।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে দুই দিনে দুই হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থী এবং লেবাননের বেসামরিকদের হত্যা করেছিল লেবাননের ডানপন্থী মিলিশিয়া গোষ্ঠী।

ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা ঠেকাতে লেবাননের কয়েকটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল। এর মধ্যে একটি ছিল শিয়া মুসলিমদের সংগঠন।

হিজবুল্লাহ গঠনের চিন্তাটি এসেছিল ইরান–সমর্থিত মুসলিম নেতাদের পরিকল্পনায়। মূলত লেবানন থেকে ইসরায়েলকে বিতাড়িত করার লক্ষ্য নিয়ে হিজবুল্লাহ নামক সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল। বেকা উপত্যকা ও বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকার তরুণ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সমর্থন নিয়ে হিজবুল্লাহ দ্রুতই লেবাননের একটি উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত হয়।

১৯৮৩ সালের হামলা

১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত লেবাননে বিদেশি সেনাদের কয়েকটি হামলা হয়েছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী এসব হামলার দায় স্বীকার করেছে। তবে অনেক হামলার জন্য হিজবুল্লাহকে দায়ী করা হয়ে থাকে।

১৯৮৩ সালের ২৩ অক্টোবর বৈরুতের বেশ কয়েকটি ব্যারাক ভবনে বোমা হামলা হয়। ওই হামলায় তিন শতাধিক ফরাসি ও মার্কিন শান্তিরক্ষী নিহত হন।

ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠী এ হামলার দায় স্বীকার করে। অনেকের বিশ্বাস, হিজবুল্লাহরই একটি অংশ এই ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠী।

১৯৮৫ সালে হিজবুল্লাহর উত্থান

১৯৮৫ সালে হিজবুল্লাহর লড়াই করার ক্ষমতা এতটাই বেড়ে যায় যে তারা মিত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একজোট হয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে লেবাননের লিতানি নদী–তীরবর্তী এলাকা থেকে সরে যেতে বাধ্য করে।

লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ ঘোষণা করে ইসরায়েল। সে নিরাপত্তা অঞ্চলটির দায়িত্ব দেওয়া হয় খ্রিষ্টান আধিপত্যশীল মিলিশিয়া বাহিনী সাউথ লেবানন আর্মিকে (এসএলএ)। এটি ইসরায়েলের ছায়া বাহিনী হিসেবে পরিচিত। ২০০০ সালে ইসরায়েলি সেনাদের প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলের দখলদারকে সমর্থন জানিয়ে গেছে তারা।

১৯৯২ সালের রাজনীতি

১৯৯২ সালে লেবাননের গৃহযুদ্ধের (১৯৭৫-১৯৯২) অবসান হওয়ার পর হিজবুল্লাহ সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে। ১২৮ আসনবিশিষ্ট পার্লামেন্টে আটটি আসনে জয় লাভ করে তারা।

এরপর হিজবুল্লাহর আসনসংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে পার্লামেন্টে ৬২টি আসন হিজবুল্লাহ ও তাদের মিত্রদের দখলে।

নিজেদের অবস্থান শক্ত—এমন এলাকাগুলোতে বিভিন্ন রকমের সামাজিক কর্মসূচি পরিচালনা করে হিজবুল্লাহ। এতেও তাদের প্রভাব বাড়ছে।

১৯৯৩ সালে ৭ দিনের যুদ্ধ

১৯৯৩ সালের জুলাইয়ে লেবাননে হামলা করে ইসরায়েল। তারা এর নাম দেয় ‘অপারেশন অ্যাকাউন্টেবিলিটি।’ লেবাননে একটি শরণার্থীশিবির ও গ্রামে ইসরায়েলি হামলার জবাবে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে পাল্টা হামলা চালানোর পর ওই অভিযান শুরু হয়েছিল। ওই সংঘাত সাত দিন স্থায়ী হয়েছিল।

ওই সংঘাতে লেবাননের ১১৮ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫০০ জনের বেশি। সংঘাত চলাকালে হাজারো ভবন ধ্বংস হয়েছে।

১৯৯৬ সালের এপ্রিলে আগ্রাসন

তিন বছর পর ১৯৯৬ সালের ১১ এপ্রিল ইসরায়েল আবারও লেবাননে হামলা শুরু করে। এই অভিযান ১৭ দিন স্থায়ী হয়েছিল। অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল হিজবুল্লাহকে লিতানি নদীর ওপারে হটানো। ইসরায়েল চেয়েছিল হিজবুল্লাহকে হটিয়ে এমন দূরবর্তী অবস্থানে নিয়ে যেতে, যেন হিজবুল্লাহ আর ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে না পারে।

ইসরায়েলের ওই অভিযানকে লেবাননের নাগরিকেরা এপ্রিল অ্যাগ্রেসন (এপ্রিল হামলা) নাম দিয়েছিলেন। আর ইসরায়েলিরা একে ডাকতেন ‘অপারেশন গ্রেপস অব র‌্যাথ’ বলে। মার্কিন লেখক জন স্টেইনবেকের ১৯৩৯ সালের উপন্যাস দ্য গ্রেপস অব র‌্যাথ-এর নামানুসারে এ নামকরণ করা হয়েছিল।

সামরিক ও বেসামরিকভাবে দুই পক্ষেরই উল্লেখজনক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং লেবাননের অবকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

১৮ এপ্রিল লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে কানা গ্রামের কাছে জাতিসংঘ চত্বরে গোলা হামলা চালায় ইসরায়েল। প্রায় ৮০০ বাস্তুচ্যুত বেসামরিক নাগরিক সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

হামলায় কমপক্ষে ৩৭ শিশুসহ ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ১১৬ জন। ফিজির চার সেনাসদস্যও তখন গুরুতর আহত হন। তাঁরা জাতিসংঘের অন্তর্বর্তী শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নিযুক্ত ছিলেন।

২০০৬ সালের জুলাই যুদ্ধ

২০০৬ সালে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হিজবুল্লাহর অভিযানে তিন ইসরায়েলি সেনা নিহত হন। আরও দুই ইসরায়েলি সেনাকে আটকে রাখে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলি সেনাদের ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে সে দেশে কারাবন্দী থাকা লেবাননের নাগরিকদের মুক্তি দাবি করেছিল হিজবুল্লাহ।

পরে একই মাসে জুলাই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ওই যুদ্ধ ৩৪ দিন স্থায়ী হয়েছিল। লেবাননের প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ মারা যান এবং ৪ হাজার ৪০০ জন আহত হন। এর বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। ইসরায়েলও তাদের ১৫৮ জন নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছিল। তাদের বেশির ভাগই সেনাসদস্য।

২০০৯ সালের ইশতেহার হালনাগাদ

ইসরায়েলের প্রতি বিরোধিতা ও ইরানকে সমর্থন—এ নীতিতে চলতে থাকে হিজবুল্লাহ। এর মধ্যে ২০০৯ সালে হিজবুল্লাহ তাদের ইশতেহার হালনাগাদ করে। তারা নিজেদের এমন একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় একীভূত করার প্রতিশ্রুতি দেয়, যেখানে সাম্প্রদায়িক স্বার্থ নয় বরং জাতীয় ঐক্য প্রতিফলিত হবে। ১৯৮৫ সালে লেখা খোলা চিঠির পর এটি ছিল হিজবুল্লাহর দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র। ১৯৮৫ সালের খোলা চিঠিতে তারা সরাসরি দেশের লক্ষ্যগুলোর বিরোধিতা করেছিল।

২০০৯ সালের ইশতেহারে হিজবুল্লাহ তাদের ইসরায়েলবিরোধী প্রতিরোধকে জোরালোভাবে তুলে ধরেছে। এতে হিজবুল্লাহ কীভাবে লেবাননের সব স্তরে পরিণত হচ্ছে, তা দেখিয়েছে তারা।

২০১২ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ

২০১২ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে দেশটির সরকারকে সমর্থন জানায় হিজবুল্লাহ। তারা ওই গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তাদের এমন পদক্ষেপকে আরব সমর্থকদের অনেকে ভালোভাবে নেননি। এমনকি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন সুভি আল তুফায়লিও এ পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছিলেন।

অবশ্য হিজবুল্লাহর সমর্থকেরা দাবি করেছিলেন, এই পদক্ষেপ লেবাননে সশস্ত্র গোষ্ঠী বিশেষ করে আইএসের মতো সংগঠনগুলোর আগ্রাসন রোধে ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি এই পদক্ষেপের কারণে যুদ্ধক্ষেত্র বিষয়ে বড় ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে হিজবুল্লাহ।

২০২৩ থেকে ২০২৪-গাজা

২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজার মানুষের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে রকেট হামলা শুরু করে হিজবুল্লাহ।

গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এতে প্রায় ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন। প্রায় আড়াই শ জনকে বন্দী করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনার পরপরই গাজায় সর্বাত্মক হামলা শুরু করে ইসরায়েল।

এর জবাবে সেদিন থেকেই গাজা উপত্যকায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল।

লেবানন ও সিরিয়ায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে হিজবুল্লাহ ও হামাসের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা নিহত হন।

২০২৪ সালের ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানের কনস্যুলার ভবনে হামলার ঘটনায় ইসরায়েলকে দায়ী করা হয়। দুই সপ্তাহ পর ইরান যখন ইসরায়েলকে পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে, তখন তেহরানকে ব্যাপকভাবে সমর্থন জুগিয়ে গেছে হিজবুল্লাহ।

গত ২৮ জুলাই ইসরায়েল অধিকৃত গোলান মালভূমিতে একটি ফুটবল মাঠে হামলায় ১২ সিরীয় শিশু ও তরুণ নিহত হন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবারও ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ—দুই পক্ষই দাবি করে এ ঘটনায় তারা জড়িত নয়। এর কয়েক দিন পর বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলে হিজবুল্লাহর কমান্ডার ফুয়াদ শোকর হত্যার শিকার হন। তখন এ হত্যাকাণ্ডকে গোলানে ফুটবল মাঠের ঘটনার পরিণতি বলে উল্লেখ করে ইসরায়েল।

ফুয়াদ শোকর নিহত হওয়ার পরপরই হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়েও নিহত হন। এই দুই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে অঞ্চলজুড়ে উত্তেজনা তৈরি হয়।

ফুয়াদ শোকরের হত্যার বদলা হিসেবে আগস্টের শেষের দিকে রকেট হামলা চালায় হিজবুল্লাহ।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর-পেজার বিস্ফোরণ

২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর লেবাননে হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহৃত কয়েক হাজার পেজার যোগাযোগযন্ত্রে বিস্ফোরণ হয়। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ইসরায়েলকে দায়ী করে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিশোধের হুমকি দেয় তারা। মূলত ১৭ সেপ্টেম্বর এই পেজার বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। গত সপ্তাহ থেকে রাজধানী বৈরুতসহ লেবাননের বিভিন্ন জায়গায় হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে জোরালো হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি বাহিনী। লেবানন সরকারের হিসাব অনুসারে, গত কয়েক দিনের হামলায় দেশটিতে এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।




পা ভেঙে হাসপাতালে ইসরাইলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রী গ্যান্টজ

ইসরাইলের যুদ্ধকালীন ক্যাবিনেট মন্ত্রী বেনি গ্যান্টজ দক্ষিণ ইসরাইলের কিবুটজ ইয়াদ মোর্দেচাইয়ের কাছে ক্রস-কান্ট্রি বাইক রাইডের সময় দূর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।

তার অফিসের উদ্ধৃতি দিয়ে হিব্রু মিডিয়া একটি বিবৃতিতে বলেছে, সোমবারের এ দূর্ঘটনায় গ্যান্টজের পা ভেঙেছে।

আশকেলনের বারজিলাই হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর গ্যান্টজকে আরও পরীক্ষার জন্য তেল আবিবের শেবা মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

ন্যাশনাল ইউনিটি দলের প্রধান ও চরমপন্থী এ নেতাকে আজকেই হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সূত্র: টাইমস অব ইসরাইল।

 




স্কটল্যান্ডের প্রথম মুসলিম প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ

স্কটল্যান্ডের প্রথম মুসলিম প্রধানমন্ত্রী হামজা হারুন ইউসাফ পদত্যাগ করেছেন। বিরোধীদের প্রস্তাবিত অনাস্থা ভোটে হারতে পারেন এমন একটি শঙ্কা থেকে সোমবার তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

স্কটিশ গ্রিনস পার্টির সঙ্গে জোট করে স্কটল্যান্ডে সরকার গঠন করেছিল হামজার দল স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি। তবে এই দলের সঙ্গে সম্প্রতি তার দল স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির জোট ভেঙে যায়। এরপর তাকে ক্ষমতা থেকে হটাতে দুটি অনাস্থা ভোটের ডাক দেন বিরোধীরা। একটি ফার্স্ট মিনিস্টার ও আরেকটি স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির সরকারের বিরুদ্ধে। এসব অনাস্থা ভোটে হামজা হেরে যেতে পারেন, এটা অনেকটা নিশ্চিত। তাই অনাস্থা ভোটের আগেই পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন তিনি।

সোমবার এক ভাষণে হামজা বলেছেন, আমি আমার মূল্যবোধ ও নীতি নিয়ে ব্যবসা করতে চাই না। অথবা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যার-তার সঙ্গে চুক্তি করতে চাই না। এর আগে চলতি মাসের শুরুর দিকে হামজা বলেছিলেন, বিরোধীদের ডাকা অনাস্থা ভোটে তিনি জিততে পারবেন বলে বেশ আত্মবিশ্বাসী। তবে সোমবারের মধ্যেই নিজের সংখ্যালঘু সরকারকে শক্তিশালী করতে অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

গত বছর স্কটল্যান্ডের ক্ষমতাসীন স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) নেতা নির্বাচিত হন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত হামজা ইউসেফ। এরপর সাবেক ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টার্জেনের স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। স্কটল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম হিসেবে ফার্স্ট মিনিস্টার নির্বাচিত হয়েছিলেন হামজা। হামজার জন্ম স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয়। তবে তার পূর্বপুরুষেরা উনিশ শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তানের পাঞ্জাব থেকে স্কটল্যান্ডে পাড়ি জমান। অবশ্য তার বাবা মুজাফফর ইউসুফের জন্ম পাকিস্তানে হলেও মা সায়িস্তার জন্ম কেনিয়ায়। সূত্র: ডন।




গাজায় যুদ্ধাপরাধ, আইসিসি’র গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে আতঙ্কে ইসরাইলি নেতারা

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গণহত্যা এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি রাজনৈতিক ও সামরিক নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির করতে যাচ্ছে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)।

তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইলের বিচার মন্ত্রণালয় এবং সেনার আইনজীবীরা এটি যাতে না ঘটে তার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছেন। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, কৌশলগত বিষয়ক মন্ত্রী রন ডার্মার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোও পরোয়ানা জারি করতে বিলম্ব বা প্রতিরোধ করতে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর করিম খানকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এটা স্পষ্ট নয় যে, তারা কতটা সফল হয়েছে।

ইসরাইলি কর্মকর্তারা বলছেন যে, তারা মনে করেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ হারজল হালেভির বিরুদ্ধে এ সপ্তাহের কোনো এক সময় পরোয়ানা দেয়া হবে। তাদের নিচের কর্মকর্তারা রেহাই পাবেন।

ইসরাইলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা মামলার শুনানিকারী আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের বিপরীতে, আইসিসি ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, রাশিয়া, ইরান এবং বেশিরভাগ আরব দেশের মতো, ইসরাইল আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দেয় তবে আইসিসি নয়।

যদি পরোয়ানা জারি করা হয়, তাহলে প্রতিটি আইসিসি সদস্য রাষ্ট্র (মোট ১২৩) যদি আসামীরা তাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে তবে আসামীদের গ্রেপ্তার করে হেগের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য। যদিও আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আপিল করার কোনো উপায় নেই, যে কোনো দেশ তাত্ত্বিকভাবে আদালতকে বলতে পারে যে, সে নিজেই মামলা পরিচালনা করছে।

 

সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রয় শনডর্ফের মতে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলে ইসরাইলের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ হতে পারে। ‘এই ওয়ারেন্টগুলো ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে লঙ্ঘনকারী হিসাবে বিবেচিত দেশগুলির সাথে গোষ্ঠীভুক্ত করবে এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে অন্যান্য সমস্ত মামলার শীর্ষে আসবে,’ শনডর্ফ বলেছেন।

ইসরাইলি কর্মর্তাদের বিরুদ্ধে কখনও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়নি। কিন্তু ২০২৩ সালের মার্চ মাসে, আইসিসি ইউক্রেনে সম্ভাব্য রাশিয়ান যুদ্ধাপরাধের তদন্তের অংশ হিসাবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে একটি পরোয়ানা জারি করেছে। ফলস্বরূপ, পুতিন সেসব দেশে যেতে পারবেন না যেখানে তিনি মনে করেন যে তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। সূত্র: হারেৎজ।

 




বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হলে সন্তান কার কাছে থাকবে?

ইসলাম ধর্মে তালাককে অপছন্দনীয় বলা হলেও তাকে ধর্মীয়ভাবে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যখন স্বামী-স্ত্রীর পক্ষে আর কোনোভাবেই একত্রে থাকা সম্ভব নয় তখন তালাকের মাধ্যমে বিচ্ছেদের সুযোগ রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী স্বামী বা স্ত্রী উভয়ে তালাক দিতে পারেন। যদিও স্ত্রীর তালাক দেওয়ার ক্ষমতাকে শর্তযুক্ত রাখা হয়েছে। এই তালাক বা বিয়ে বিচ্ছেদের ফলে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয় ওই দম্পতির ঘরে কোনো সন্তান থাকলে সে। বিশেষ করে সন্তানের হেফাজত বা রক্ষণাবেক্ষণ, খরপোষ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা। এসব জটিলতা নিয়ে শেষ পর্যন্ত আদালতে দ্বারস্থ হতে হয় অনেককে।

অভিভাবকত্ব কার:

অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০ অনুযায়ী বাবা হচ্ছে সন্তানের প্রকৃত আইনগত অভিভাবক। তবে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হলে শিশুর লালন-পালনের স্বার্থে মা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শিশু সন্তানকে জিম্মায় রাখার আইনগত অধিকারী। যদিও ওই সময়েও ভরণপোষণ বাবাকেই দিতে হবে।

সন্তানের স্বাভাবিক জিম্মাদার কে:

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হলে স্বাভাবিকভাবে ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে সাত বছর এবং মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত সন্তান মায়ের জিম্মায় বা রক্ষণাবেক্ষণে থাকবে। এক্ষেত্রে বাবা আইনগত অভিভাবক হলেও মা হচ্ছে সন্তানের হেফাজতকারী বা জিম্মাদার। তবে এ সময়েও সন্তানের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের অধিকার বাবার থাকবে। এই সময়ের পর সন্তানদের তার বাবা চাইলে নিয়ে যেতে পারে। নির্দিষ্ট এই সময়ের পরও যদি মা সন্তানকে নিজের জিম্মায় রাখতে চান, তখন আদালতের অনুমতি নিতে হবে।

কোনো আদালতে যাবেন:

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩ এর ৫ ধারার বিধান মোতাবেক শিশু সন্তানদের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধান সম্পর্কিত যেকোনো মোকদ্দমা গ্রহণ, বিচার এবং নিষ্পত্তির এখতিয়ার পারিবারিক আদালতের। এ ধরনের মামলায় আদালত সন্তানের কল্যাণের জন্য যেটা সবচেয়ে ভালো, সেই বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এক্ষত্রে আর্থিক স্বচ্ছলতা, সন্তান লালন-পালনের জন্য বাবার পরিবারে কেউ আছে কি না, মাদকাসক্ত কি না এসব বিষয়ও বিবেচনা করে থাকেন। এক্ষেত্রে অনেক সময় সম্মত হলে দুইজনের মধ্যে ভাগ করে হেফাজত দেওয়া হয়ে থাকে। হয়তো সপ্তাহে দুইদিন বাবার কাছে এবং বাকি পাঁচদিন মায়ের কাছে থাকলো, এভাবেও দেওয়া হয়। তবে যার হেফাজতেই থাকুক না কেন অপরপক্ষের সন্তানকে দেখার সময় কাটানোর সুযোগ আদালত দিয়ে থাকে। সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হলেও আইনের আশ্রয় নেওয়া যায়।

সন্তানের মতামত কি গ্রহণ করা হয়: 

হেফাজত বা জিম্মাদারি দেওয়ার ক্ষেত্রে সন্তানের মতামতের গুরুত্ব সবসময়ই থাকে। এক্ষেত্রে আদালত শিশুর মতামতও গ্রহণ করে থাকে। তবে অনেক সময় দেখা যায়, যার হেফাজতে আছে সে সন্তানকে প্রভাবিত করে বা ভয় দেখিয়ে মতামত নিতে পারে। তাই সন্তানের মতামত নেওয়ার পরও আদালত সেটি পর্যবেক্ষণ করেন। তাই মতামত বিবেচনার বিষয় হলেও শুধু শিশু সন্তানের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই জিম্মাদারি দেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে শিশু কার হেফাজতে থাকলে প্রকৃতপক্ষে তার অধিক কল্যাণ হবে আদালত সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করেন। যেমন ভরণপোষণ বা লালন-পালনের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়গুলোও এক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়।




দুর্নীতি, আলাদীনের চেরাগ ও প্যান্ডোরার বাক্স

আরব্য রজনীর আলাদীনের চেরাগের আধুনিক সংস্করণের নাম ক্ষমতা, যে চেরাগ জ্বালিয়ে কোনো দৈত্যের সাহায্য ছাড়াই বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়া যায়। আর যে কৌশলে এই সম্পদের মালিক হওয়া যায় তার নাম দুর্নীতি।

অর্থাৎ ক্ষমতা, দুর্নীতি ও সম্পদ এখন একে অপরের পরিপূরক।

গল্পের আলাদীন তার চেরাগে ঘষা দিলে দৈত্য এসে তাকে বলত, ‘হুকুম করুন মালিক। ’

কিন্তু বাস্তবে আলাদীনের দৈত্যের চেহারাটা ভিন্ন। এই দৈত্য কখনো প্রশাসনিক ক্ষমতা, কখনো অস্ত্রের ভয়, কখনো মামলার আসামি করে কোর্টে চালান কিংবা ক্রসফায়ারের ভয় এবং কখনো বড় কোনো সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভনরূপে আবির্ভূত হয়।

সবশেষ যার ‘আলাদীনের চেরাগ’ নিয়ে সারা দেশে তোলপাড়, তিনি সাবেক পুলিশপ্রধান ও র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। যিনি রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারও পেয়েছেন।

২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেওয়াসহ নানা ঘটনায় আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তার যে চেহারা বা স্বরূপ দেশবাসী দেখেছে, তাতে তাঁকে বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা’ বললেও বোধ হয় ভুল হবে না। প্রশ্ন হলো, কালের কণ্ঠ গত ৩১ মার্চ ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনে এ রকম একজন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ব্যক্তির অঢেল সম্পদ অর্জনের যে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিল, সেটি কী বার্তা দিচ্ছে?

দুটি প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

১. বাংলাদেশে একটি ‘স্বাধীন’ দুর্নীতি দমন কমিশন আছে এবং তারা অনেক বড় ও মাঝারি দুর্নীতিবাজকে আইনের জালে বন্দি করেছে। অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে। অনেকের তদন্ত চলমান। বেনজীর আহমেদের মতো একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি, যিনি অনেক বড় ঘটনার সময় রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁর সম্পদের ব্যাপারে দুদক কোনো খোঁজখবর জানল না?

২. প্রতিবেদনে তার যে সম্পদের বিবরণ দেওয়া হয়েছে, সেটি টাকার অঙ্কে অনেক। যেমন, গোপালগঞ্জে সাভানা ইকো রিসোর্ট নামে বিলাসবহুল পর্যটনকেন্দ্র; স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ছয়টি কম্পানিতে ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ; রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোয় দামি ফ্ল্যাট, বাড়ি আর ঢাকার কাছেই দামি এলাকায় বিঘার পর বিঘা জমি; দুই মেয়ের নামে বেস্ট হোল্ডিংস ও পাঁচতারা হোটেল লা মেরিডিয়ানে দুই লাখ শেয়ার; পূর্বাচলে ৪০ কাঠার সুবিশাল জায়গাজুড়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি এবং ২২ কোটি টাকা মূল্যের আরো ১০ বিঘা জমি ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো, বেনজীর আহমেদ এই সম্পদ কোন প্রক্রিয়ায় অর্জন করেছেন?

প্রশ্নটা এ কারণে যে একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে তাঁর সারা জীবনের যে বেতন, বোনাস ও অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা এবং অবসরের পরে তিনি যে টাকা পেয়েছেন তা দিয়ে জীবনধারণের পরে যে টাকা উদ্বৃত্ত থাকার কথা, সেই টাকা দিয়ে ঢাকা শহরে একটি ছোটখাটো বাড়ি কেনাও অসম্ভব। অথচ গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে তাঁর যে সম্পদের বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে, তা তাঁর সারা জীবনের আয়ের কয়েক শ বা কয়েক হাজার গুণ বেশি।

এই টাকা তিনি কোথায় পেলেন বা কোন প্রক্রিয়ায় অর্জন করলেন?

মোটা দাগে তিনটি উপায়ে ধনী হওয়া যায়।

১. পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত বিপুল সম্পদ।

২. বড় ব্যবসা।

৩. দুর্নীতি।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় যত বড় এবং যত উচ্চ বেতনের সরকারি চাকরিই হোক না কেন, তাতে কারো পক্ষে ঢাকা শহরে দুই-তিন কোটি টাকা দিয়ে একটি ফ্ল্যাটের মালিক হওয়াও কঠিন, যদি মোটা অঙ্কের ব্যাংক লোন না থাকে। শুধু বেতনের পয়সায় জীবন ধারণের পরে একজন সরকারি চাকরিজীবীর অনেক বেশি টাকা সঞ্চয় করার কোনো সুযোগ নেই। অথচ তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির অনেক কর্মচারী ঢাকা শহরে একাধিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, গাড়ি, ঢাকার কাছেই রিসোর্ট, গ্রামের বাড়িতে সুরম্য দালান, বিঘার পর বিঘা ফসলের জমির মালিক হয়েছেন—এ রকম অনেক খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কারাগারে আছেন। আবার অনেকে খবরের পাতা থেকেও হারিয়ে গেছেন। এর বাইরে আরো অসংখ্য লোক এখনো আলাদীনের চেরাগ অর্থাৎ ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি করে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হচ্ছেন।

সুতরাং বেনজীর আহমেদের এই ঘটনাটি খুব নতুন কিংবা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। এটি দুর্নীতিগ্রস্ত অর্থনীতির একটি ছোট্ট কেস স্টাডি মাত্র। তবে আর ১০টি ঘটনার সঙ্গে এর মৌলিক পার্থক্য হলো, বেনজীর আহমেদ যে পরিমাণ প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং এই সময়ের সাংবাদিকতায় যেখানে ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের দুর্নীতি ও অপরাধ পারতপক্ষে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়, সেখানে কালের কণ্ঠ যে প্যান্ডোরার বাক্সটি খুলে দিল কিংবা দিতে পারল, এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

‘দেশে সাংবাদিকতা নেই’ বা ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হয় না’ বলে যাদের মন খারাপ, তাদের জন্য এ ধরনের প্রতিবেদন আশার সঞ্চার করে। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে যখন ঘরে ঘরে সাংবাদিক, যখন ইউটিউবের কনটেন্ট ক্রিয়েটররাও নিজেদের সাংবাদিক দাবি করেন এবং যখন সোশ্যাল মিডিয়ার কাছে মূল ধারার গণমাধ্যম হেরে যাচ্ছে বলে মনে হয়, তখন এ ধরনের সাংবাদিকতা শুধু একটি-দুটি পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেল নয়, বরং পুরো গণমাধ্যম সম্পর্কেই জনপরিসরে বিদ্যমান নেতিবাচক ধারণায় কিছুটা হলেও আঘাত করে। এ ধরনের সাংবাদিকতায় ঝুঁকি অনেক বেশি। কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি।

প্রতিবেদনের দুর্বল জায়গা হলো অভিযুক্তের বক্তব্য নেই। যদিও এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযোগের বিষয়ে জানতে বেনজীর আহমেদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদে বার্তায়ও সাড়া দেননি। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত দুটি ঘটনা ঘটে। ১. অভিযুক্ত ব্যক্তি সাংবাদিকের ফোনে সাড়া দেন না অথবা ২. কোনো কোনো খবরে লেখা হয়, অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি তা অস্বীকার করেন অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি মিথ্যা ও অপপ্রচার বলে দাবি করেন। অতএব, এ ধরনের দায়সারা বক্তব্য আখেরে খুব বেশি কার্যকর না হলেও সাংবাদিকতার নীতিমালা ও কাঠামোর প্রয়োজনে অভিযুক্তের বক্তব্য প্রয়োজন হয়।

এই ধরনের দুর্নীতির খবর দুটি বিষয়কে সামনে আনে।

১. দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের যে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীল নীতি, সেটির বাস্তবায়ন কোথায়? পুলিশ বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের নামও কি সরকার জোর গলায় বলতে পারবে যেটি পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত হয়েছে কিংবা যেখানে দুর্নীতি কমেছে? সরকারি সেবাদানকারী অনেক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ইন্টারনেটভিত্তিক তথা ডিজিটাল করার পরও কি ওই সব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি কমেছে?

২. যেকোনো বাহিনীর যেকোনো পর্যায়ের সদস্যের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ উঠলে কিংবা প্রমাণিত হলে সঙ্গে সঙ্গে বাহিনীর তরফে বলে দেওয়া হয়, ব্যক্তির অপরাধের দায় বাহিনী বা সরকার নেবে না। প্রশ্ন হলো, কোনো একটি বাহিনী বা প্রতিষ্ঠানে যদি কাঠামোগত সমস্যা থাকে; যদি সেখানের সিস্টেমটাই হয় এমন যে প্রশাসনিক ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে কিংবা দ্রুত কাজ করে দেওয়া অথবা কাউকে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া যায় এবং দুর্নীতি করে সহজে পার পেয়ে যাওয়া যায়, তাহলে ওই বাহিনী বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত কোনো ব্যক্তির অপরাধের দায় কেন সংশ্লিষ্ট বাহিনী বা প্রতিষ্ঠান এবং সরকার নেবে না?

লেখক : সাংবাদিক ও লেখক (কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর ও সঞ্চালক, নেক্সাস টেলিভিশন)




কিশোর গ্যাং: সন্তান মিশছে কার সঙ্গে?

বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গ্যাং সদস্যরা ঘটাচ্ছে নানা অঘটন।

খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করছে না।

 

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নানামুখী তৎপরতার পরও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কিশোর অপরাধীদের। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ তটস্থ। কারণ কিশোর গ্যাং সদস্যদের এসব অপকর্মের মূলে থাকে তাদের কথিত ‘বড়ভাই’। শুধু দেশের শহরগুলোতেই নয়, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এখন বিভিন্ন উপজেলায়ও তৎপর।

গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, সারাদেশেই ‘কিশোর গ্যাং’ সক্রিয়। ঢাকা শহরে কিশোর গ্যাং আছে ৭০টির বেশি। ২০২৩-এর জুলাই থেকে চলতি বছরের এখন পর্যন্ত এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের প্রধানসহ ২০০ জনের বেশি গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-পুলিশ। বর্তমানে বিচারাধীন দুই হাজার ২৩২টি মামলার বেশিরভাগ কিশোর গ্যাং সংক্রান্ত। ২০২৩ সালে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে শুধু ঢাকাতেই ২৫ জন খুন হয়েছেন। ২০২২-২৩ দুই বছরে তাদের হাতে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে (সূত্র: ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ) ।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ১৬টি থানার তথ্যমতে, চট্টগ্রাম নগরে এখন সক্রিয় রয়েছে দুই শতাধিক কিশোর গ্যাং। একেক দলে রয়েছে ৫ থেকে ১৫ জন। নগরজুড়ে এদের সদস্যসংখ্যা প্রায় দুই হাজার। কিশোর গ্যাংকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন ৬৪ ‘বড় ভাই’। নগরের গুরুত্বপূর্ণ ৪৫টি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে তারা। বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, সরকারি দপ্তরগুলোতে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, গার্মেন্ট ব্যবসা, জমি দখল, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল কিংবা কোণঠাসা করাসহ বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে গ্রুপিং, সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনায় জড়িত কিশোর গ্যাং লিডাররা। আর গ্রুপ ভারী করতে কথিত বড়ভাইরা কিশোর-তরুণদের বিপথগামী করে তুলছে। এদের বেশিরভাগই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। নামে কিশোর গ্যাং হলেও দলে ২০ থেকে ৩২ বছর বয়সীরাও রয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত, মাদক ও ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করছে নগরের মানুষ।

কিশোর অপরাধের মামলাও বেড়েছে চট্টগ্রাম আদালতে। বর্তমানে দুই হাজার ২৩২টি মামলা বিচারাধীন। এসব মামলার বেশিরভাগ কিশোর গ্যাংসংক্রান্ত বলে সরকারি কৌঁসুলিরা জানিয়েছেন। দ্রুত নগরায়ণ কিশোরদের অবসর সময় কাটানোর পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। পরিবার ও সমাজ-কাঠামোর পরিবর্তন এবং খেলাধুলা ও অন্যান্য বিনোদন মাধ্যমের অনুপস্থিতি ও সংকুচিত হওয়ার কারণে অবসর বিনোদনের ঘাটতি পূরণ হচ্ছে কৃত্রিম পরিবেশ ও আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে।

অভিভাবকদেরও অনেকটা ব্যস্ততার কারণে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটানো ও সঙ্গ দেওয়ার সময় নেই কিংবা কেউ কেউ প্রয়োজনও বোধ করছে না। এখন প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। গ্রুপের ভালো-মন্দ বোঝার মতো ক্ষমতা কিশোরদের মধ্যে নাও থাকতে পারে। উঠতি বয়সের কিশোরদের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা কাজ করে। তারা অন্য কারো দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। কোনো প্রকার ভৌত অবকাঠামো ছাড়াই তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে এক জায়গায় একত্র হয়ে অপরাধমূলক কাজের পরিকল্পনা, খুন ও হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ তারা করছে।

বিপরীতে সমাজে এমন গ্রুপও রয়েছে, যারা বয়সে তাদের মতোই কিশোর, পড়াশোনা করছে কোনো না কোনো কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমনকি পড়াশোনাও হয়তো করছে না; কিন্তু নিজেদের টাকা খরচ করে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের জন্য গ্রুপ গঠন করছে। তারা শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে, রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছে, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো কিংবা স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে। এমন কিশোর-কিশোরীরাও আমাদের সমাজেরই মানুষ। তাদের বেড়ে ওঠা ও বড় হওয়ার ভিন্নতার জন্য, পরিবার ও সমাজের ভিন্নতার জন্য এবং খারাপ কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত হওয়া কিংবা সুযোগ গ্রহণ না করার জন্য তারা প্রশংসিত।

সমাজে যখন আমরা ভালো-মন্দ উভয় দিক খেয়াল করি, তখন খারাপ গ্রুপকে ভালো করার কাজটি আমাদেরই করতে হবে। এমন সব কাজ করতে হবে, যেখানে খারাপ হওয়ার সুযোগ তৈরি না হয়। কিশোরদের মাঝে বড় বিষয় হলো অল্প বয়স ও পরিপক্বতার অভাব, যার কারণে কোনটি সঠিক আর কোনটি সঠিক নয়, তা বুঝতে না পারা। ফলে অনেক সময়ই গ্যাং কালচারকে বড় বিষয় মনে হয়। শারীরিক পরিবর্তন এবং এর সঙ্গে মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবার ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাদের সংঘবদ্ধ হতে এবং গ্রুপ গঠন করতে সহায়তা করে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলা প্রশাসক সম্মেলন উদ্বোধন উপলক্ষে ভাষণ দানকালে সমাজে কিশোর গ্যাং সমস্যার প্রসঙ্গ টেনে সন্তান-সন্ততিদের প্রতি নজরদারি বাড়াতে প্রতিটি পরিবারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কারও ছেলেমেয়ে যেন কিশোর গ্যাং, জঙ্গি, সন্ত্রাস ও মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়তে না পারে। শুধু গ্রেপ্তার করে লাভ নেই, সচেতন হতে হবে। তাই গোড়া থেকে ধরতে হবে। কোভিড-১৯ চলাকালে এর বিস্তার ঘটেছে এবং এই সময়ে এটি সবচেয়ে বেশি সামনে এসেছে। এই গ্যাং কালচারের লাগাম টানার কাজটা পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পর সারাদেশে সর্বস্তরে এই সমস্যা নিরোধের জন্য ব্যাপক সচেতনতা তৈরি হয়েছে।

আমাদের দরকার শিশু-কিশোরদের ঘরে বন্দি না রেখে তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া এবং উদ্বুদ্ধ করা। মা-বাবাকেই এমন উদ্যোগ নিতে হবে। এতে কিশোরদের মধ্যে মানবতাবাদী, সহমর্মিতাবোধ ও সহানুভূতির বীজ রোপিত হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কাউট কাব, গার্লস গাইড, বিএনসিসি, রোভার স্কাউটসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি প্রদানের ক্ষেত্রে সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকাও বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। আর কারও ক্ষেত্রে অসংযত আচরণ পরিলক্ষিত হলে ব্যবস্থা নিতে হবে, শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নয়।

পুলিশের একার পক্ষে এটি রোধ করা সম্ভব নয়। আমাদের সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, পরিবারকে অবশ্যই তা খেয়াল রাখতে হবে।