যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক না থাকলে বিপদে পড়বে ক্ষুদ্র ব্যবসা
গত বুধবার (২৪ এপ্রিল) মার্কিন সিনেটে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ টিকটক নিষিদ্ধ করার জন্য বিল পাস হয়েছে। কয়েক ঘণ্টা পরে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিলটিতে স্বাক্ষর করেন, ফলে এটি আইনে পরিণত হয়। এই আইনের কারণে টিকটকের মূল সংস্থা বাইটড্যান্সকে চীনের বাইরের অর্থাৎ অন্য কোনো দেশের কোনো সংস্থা বা ব্যক্তির কাছে অ্যাপটি বিক্রি করতে হবে। নতুবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক বন্ধ করতে হবে। টিকটক অবশ্য এই আইনটিকে চ্যালেঞ্জ করে আইনি লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে।
আগামী বছর নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মের অনেক ভক্ত অনুরাগী তাদের প্রিয় অবসর কাটানোর একটি মাধ্যমকে হারাতে পারেন। তবে টিকটক না থাকলে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে টিকটকের কন্টেন্ট ক্রিয়েটর এবং এই মাধ্যমটি ব্যবহার করে আয় করা ছোট ছোট ব্যবসাগুলো।
২০২৪ সালের মার্চের তথ্য অনুযায়ী, ৭০ লাখের বেশি মার্কিন ক্ষুদ্র ব্যবসা টিকটক ব্যবহার করে। টিকটক জানিয়েছে, ২০২৩ সালে এই ব্যবসায় উদ্যোগগুলোর জন্য তারা ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে।
টিকটক বর্তমানে একটি অন্যতম বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে। টিকটকের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই প্লাটফর্ম ব্যবহার করে গড়ে উঠা ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোগ জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস এবং বেলজিয়ামের জিডিপিতে ৪.৮ বিলিয়ন ইউরো বা ৫.১৪ মার্কিন ডলার অবদান রাখছে।
টিকটক বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় মার্কিন উদ্যোক্তারা তাদের আয় হ্রাসের আশঙ্কা করছেন। একইভাবে বিশ্বব্যাপী ব্যবসাগুলোও পণ্যের মার্কেটিংয়ে মার্কিন ক্রেতাদের টার্গেট করে থাকে। কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদেরও শীর্ষ টার্গেট মার্কিন অডিয়েন্স। তাই বিশ্বব্যাপী সামাজিক যোগাযোগ প্লাটফর্ম নির্ভর করে গড়ে উঠা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েটররাও চিন্তিত। তাদের জন্য এখন টিকটকের বিকল্প খোঁজা বড় চ্যালেঞ্জ।
ক্রমবর্ধমান অডিয়েন্স ও ভোক্তার সন্ধান
২৭ বছর বয়সী শিরা টিকটকে একজন ফুলটাইম কন্টেন্ট ক্রিয়েটর। টিকটকে তার ফলোয়ার পাঁচ লাখের বেশি। অস্ট্রেলিয়া থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পরে ২০২১ সালে টিকটকে একাউন্ট খুলেছিলেন তিনি। শুরুর দিকে তিনি অন্যান্য কন্টেন্টের উপর প্রতিক্রিয়া ভিডিও তৈরি করতেন। সেইসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের অভিজ্ঞতা নিয়েও কন্টেন্ট বানাতেন তিনি। নয় মাসের মধ্যে তার ফলোয়ার সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
আয়ের জন্য শিরা টিকটকের পার্টনারশিপের উপর নির্ভর করেন। স্ন্যাপচ্যাট ও ইউটিউবেও অ্যাকাউন্ট রয়েছে তার, কিন্তু তার মতে, ধারাবাহিকভাবে সবচেয়ে বেশি আয়ের প্লাটফর্ম হলো টিকটক। তিনি বিবিসিকে বলেন, টিকটকে সত্যিকারের নিবেদিতপ্রাণ অডিয়েন্স বাড়াতে আমি কয়েক বছর সময় দিয়েছি। অনেক লাইভ স্ট্রিম করেছি, বহু কন্টেন্ট দিয়েছি। টিকটক থেকে অর্থ উপার্জনের যাত্রা ছিল কঠিন। কিন্তু এখন আমি যে জায়গায় পৌঁছেছি তাতে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।
শিরা এই নিষেধাজ্ঞাকে বিধ্বংসী বলে বর্ণনা করেছেন। তার নিজের ব্যবসার বাইরেও তিনি বলেছেন, সম্ভাব্য কয়েক হাজার চাকরি যাবে এই নিষেধাজ্ঞার কারণে। এর আগে গত মার্চে টিকটক জানিয়েছিল, অ্যাপটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে দুই লাখ ২৪ হাজার চাকরি তৈরি করেছে। শিরা বলেন, টিকটক নিষিদ্ধ হলে এই লোকরা কী করবে তা আমি নিশ্চিত নই।
৩০ বছর বয়সী ইলিয়ানা জাস্টিনের টিকটক অ্যাকাউন্টে ফলোয়ার সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। তিনিও শিরার মতো একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ২০২১ সালে তিনি এবং তার স্বামী করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে তাদের আসন্ন বিয়েতে অতিথিদের মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে টিকটকে পোস্ট করেন। এর মাধ্যমে তিনি তার টিকটক অ্যাকাউন্টে কন্টেন্ট প্রকাশ শুরু করেন। এর পর থেকেই তিনি বিতর্কিত বিষয়বস্তুর কন্টেন্ট নির্মাতাদের জগতে প্রবেশ করেন। তিনি মূলত লাইফস্টাইল, রাজনৈতিক বিষয়াবলী নিয়ে কন্টেন্ট তৈরি করেন। তার কন্টেন্টের বিষয়ের মধ্যে রয়েছে সবেতন পারিবারিক ছুটি, গর্ভপাত এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়।
তবে শিরার মতো ফুলটাইম কন্টেন্ট ক্রিয়েটর নন ইলিয়ানা। কিন্তু প্লাটফর্মটিতে অনেক সময় দেন তিনি। তার নিজের অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশের বাইরেও তিনি অন্যদের জন্য উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে যারা টাকা আয়ের জন্য পুরোপুরি টিকটকে তাদের সাফল্যের উপর নির্ভরশীল তাদের নিয়ে চিন্তিত তিনি। ইলিয়ানা বলেন, প্লাটফর্মটি ছোট ব্যবসায়ীদের পণ্য মার্কেটিং এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বড় করার সুযোগ দেয়। টিকটক ব্যবহার করে ব্যবসাকে সম্পূর্ণভাবে রূপান্তরিত করা যায়। আমার অনেক বন্ধু আছে যারা তাদের ব্যবসাকে টিকটকের কারণে ফুলটাইমে চাকরিতে পরিণত করতে পেরেছে।
বিকল্পের সন্ধান
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, টিকটক নিষিদ্ধ হলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য খুব বেশি ক্ষতিকর নাও হতে পারে। কিন্তু তাদের অবশ্যই কোনো বিকল্প খুঁজে পাওয়া ও তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাধ্য করবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারডু ইউনিভার্সিটি ড্যানিয়েলস স্কুল অব বিজনেসের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ রহমান বলেন, আমরা একটি ডিজিটাল অর্থনীতিতে বাস করছি। আমরা মূলত সব ধরনের যোগাযোগ এবং তথ্যের জন্য প্রযুক্তির উপর নির্ভর করছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসার আগে কিভাবে ব্যবসা হতো সেদিকে ফিরে যাওয়ার ধারণাটি সম্ভবত আর কাজ করবে না। কারণ আমরা কিভাবে তথ্য সংগ্রহ করব, কিভাবে আমরা কী কিনব সে বিষয়ে ভোক্তারা বিশ্বজুড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে প্রভাবিত হয়।
যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে ফেসবুকের মতো বিকল্প রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও আসতে পারে। ব্যবসার জন্য তাদের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো বের করার জন্য হাতে রয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট বাইডেন টিকটক নিষিদ্ধ বা বিক্রির আইনটিতে স্বাক্ষরের পর বাইটড্যান্সের হাতে ২৭০ দিন সময় আছে। তবে বাইটড্যান্স আইনি লড়াই করলে এই সময় আরও বাড়তে পারে।
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির মার্শাল বিজনেস স্কুলের ক্লিনিকাল বিপণনের সহযোগী অধ্যাপক ক্রিস্টেন শিয়েলি মনে করেন, টিকটক বন্ধ হলে ব্যবহারকারীরা কোনো প্লাটফর্মে স্থানান্তরিত হবে তা এখনই বলা কঠিন। আসলে জেন জেডরা টিকটকে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ করে। অন্য প্লাটফর্মগুলোর লক্ষ্য হচ্ছে জেন জেডের কাছে পৌঁছান।
আমেরিকান টিকটক ব্যবহারকারীরা শুধু দেশীয় ব্যবসায়িক শক্তিই নন, বরং বিশ্বব্যাপী তাদের প্রভাব রয়েছে। অন্যান্য দেশের উদ্যোক্তারা টিকটকে মার্কিন অডিয়েন্স হারাবেন। যুক্তরাজ্য ও কানাডার কেউ কেউ ইতিমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গত মার্চে কানাডায় টিকটকের মুখপাত্র গ্লোবাল নিউজকে ইমেইলের মাধ্যমে বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ হলে কানাডিয়ান কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ও ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলোর জন্য তা ধ্বংসাত্মক ব্যাপার হবে। কানাডার ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের বড় অংশের মূল লক্ষ্যই থাকে আমেরিকানদের কাছে পৌঁছানো।
শিয়েলি বলেন, কোরিয়া ও চীন থেকে প্রচুর কসমেটিক ও ত্বকের যত্নের ব্র্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রে আসছে। কোরিয়া ও চীনের সৌন্দর্যবর্ধন ও ত্বকের যত্নের পণ্যগুলোর মান দুর্দান্ত। এই মুহূর্তে টিকটকে এগুলোর ব্যবসা অনেক বড়। তাদেরও টিকটক ছাড়া মার্কিন গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর পক্ষেও মার্কিন গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানো কঠিন হবে। শিয়েলির আশা, অনেকেই মানিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু তার উদ্বেগের যায়গাটি হলো, বড় কোম্পানি ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের দাপটে ছোট অনেক উদ্যোগ হারিয়ে যাবে।