লোকাল ট্রেনগুলো চালু হবে কবে

১৯৩১ সালের দিকে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন চালু হয়। তখন ৬ জোড়া ট্রেন চলাচল করত এই রুটে। দোহাজারী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত দক্ষিণ চট্টগ্রামের ১২টি স্টেশনে প্রতিদিন কয়েক হাজার যাত্রী রেলসেবা পেতেন। পরে পর্যায়ক্রমে রুটটিতে কমতে থাকে ট্রেনের সংখ্যা। ট্রেনের সংখ্যা ৯০ দশকের দিকে এক জোড়ায় এসে ঠেকে। তবে যাত্রীদের দাবির মুখে ২০১৮ সালে আবারও এক জোড়া ট্রেন চালু করা হয়। পরে ২০২১ সালে যুক্ত হয় এক জোড়া ডেমু ট্রেন।
কভিডকালে ২০২১ সালের ৩ এপ্রিল থেকে একই সঙ্গে ডেমু ও লোকাল ট্রেন চলাচল বন্ধ করা হয়েছিল। পরে একই বছরের ১৯ আগস্ট দুই জোড়া ট্রেন পুনরায় চালু করা হলেও পরে ২০২৩ সালে কালুরঘাট সেতু মেরামতের জন্য তা বন্ধ করা হয়। এখন পর্যন্ত লোকাল ট্রেন আর চালু হয়নি।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম- দোহাজারী রেলপথকে কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ নামে প্রথম বাণিজ্যিক ননস্টপ আন্তনগর ট্রেন চলাচল শুরু করে। সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি থেকে যুক্ত হয় ‘পর্যটক এক্সপ্রেস’ নামে আরও এক জোড়া নতুন আন্তনগর ট্রেন। সঙ্গত কারণে এ দুটি ট্রেন মাঝখানে আর কোনো স্টেশনে থামে না।
পটিয়া, চন্দনাইশ ও বোয়ালখালী এলাকার অনেক মানুষ চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন, যাঁরা নিয়মিত গ্রাম থেকে যাতায়াত করেন। অনেক শিক্ষার্থীকেও নগরের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত যাতায়াত করতে হয়। এছাড়া দোহাজারীতে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির চাষাবাদ হয়। এসব শাকসবজি ট্রেনে করে চট্টগ্রাম নগরে বিক্রির জন্য কম খরচে নিয়ে যেতেন কৃষক ও পাইকারেরা। ট্রেন চালু থাকলে তাঁরা কম খরচে ভোগান্তি এড়িয়ে যাতায়াত করতে পারতেন।

এদিকে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, চালু হতে যাচ্ছে এই রুটে লোকাল ট্রেন। প্রস্তাবিত কমিউটার ট্রেনটি চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে ছেড়ে ষোলশহর, জানআলী হাট, পটিয়া, দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ ও রামু স্টেশন থেকে যাত্রী ওঠানামা করাবে। সর্বশেষ ট্রেন গিয়ে থামবে পর্যটন নগরী কক্সবাজার আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনে।
এটি ফেব্রুয়ারি থেকে চালু হওয়ার কথা থাকলেও মার্চের মাঝামাঝিতে এসেও চালু হয়নি। কিন্তু এই কাজটি অগ্রাধিকার তালিকায় হওয়া উচিত ছিল। কারণ কালুরঘাটের একটি সেতুর কারণে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিপুল সংখ্যক মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে। দ্বিতীয়ত রেলওয়ের মতো গণমুখী, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থাকে যেকোনো মূল্যে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কাজেই আমরা চাই দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ দেশের সব লোকাল ট্রেনগুলো পূর্ণমাত্রায় সচল হোক।




সেহরির পর ধূমপান করলে রোজা হবে কি?

সেহরির পর ধূমপান করলে রোজা হবে কি?

পবিত্র রমজান মাস চলছে। এ সময় সব মুসলমানের চেষ্টা থাকে সঠিক নিয়মে রোজা পালন করা। এখানেই সমস্যায় পড়ে অনেকে। এক্ষেত্রে যারা ধূমপান তরে থাকে তাদের সমস্যা একটু বেশি।

রোজায় ধূমপান করতে গিয়ে রোজার কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি না তা নিয়ে সংসয়ে পড়ে যায় অনেকে। এমন সংসয় থাকা স্বাভাবিক। কারণ ধূমপান করা এমনিতেই ঠিক না। ইসলামেও এটা নিষেধ করা হয়েছে।
রোজা থাকা অবস্থায় ধূমপান করলে রোজা ভঙ্গ হয়। তাই রমজানে দিনের বেলায় বিশ্বাসী মুমিন রোজাদার ব্যক্তি ধূমপান করেন না। এখন প্রশ্ন হলো সেহরিতে বা ইফতারের পর ধূমপান করলে রোজার ক্ষতি হয় কি না?
একটি বেসরকারি টেলিভিশন অনুষ্ঠান চলাকালে বিশিষ্ট আলেম ড. মুহাম্মদ সাইফুল্লাহর কাছে এমন একটি প্রশ্ন করা হয়। যার জবাবে তিনি বলেন- যেটা হারাম, সেটা হারামই হবে। যেটা খারাপ, সেটা খারাপই। সুতরাং, এটা পরিহার করার জন্য চেষ্টা করুন। সেহেতু আপনি আল্লাহর বান্দা হিসেবে সিয়াম পালন করতে পারছেন, এই দীর্ঘ সময় আপনি ধূমপান ছাড়া থাকতে পারছেন, তাহলে বোঝা গেল আপনি এটা অবশ্যই পরিহার করতে পারবেন। আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্য সিয়াম পালন করছেন। হারাম কাজের মধ্যে নিজেকে জড়িত করে আপনি যতই সামনে দৌড়ান না কেন, আপনি সামনে যেতে পারবেন না।
তিনি আরও বলেন, হারাম কাজ আপনাকে পেছনে নিয়ে যাবে। যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা, মিথ্যাচার এবং যে গর্হিত বিষয় আছে, সেগুলো পরিহার করতে পারল না, তার সিয়াম শুধু লোক দেখানো হবে। এই সিয়ামের মাধ্যমে আপনি আল্লাহর মূল উদ্দেশ্য পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবেন না।



পরবর্তী প্রজন্মকে ওপরে উঠানোই শিক্ষার লক্ষ্য

জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব বর্ণনা করে বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এম জাহিদ হাসান তাপস বলেছেন, শিক্ষা মানুষের পরবর্তী প্রজন্মকে ওপরে উঠিয়ে দেয়। জ্ঞান অর্জন না করে কাজ করতে চাইলে অনেক ভুলভ্রান্তি হতে পারে।
গাজীপুরের শ্রীপুরে একটি বিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনায় গতকাল রোববার এমন মন্তব্য করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।
শ্রীপুর পৌরসভার সুলতান উদ্দিন মেমোরিয়াল একাডেমিতে এদিন সুলতান উদ্দিন স্মৃতি বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন ‘ভাইল ফার্মিয়ন’ নামের একটি অধরা কণা আবিষ্কারে নেতৃত্ব দেওয়া
জাহিদ হাসান।
কৃতী এই বিজ্ঞানী কোনো জাতির উঠে আসার পেছনে শিক্ষা বিস্তারের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য সুন্দর মানসিকতার মানুষ তৈরি করা। শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো– জ্ঞান অর্জন করা ও সেই জ্ঞান প্রয়োগ করা। জ্ঞান অর্জন করে যদি মানুষ খারাপ কাজ করে বা কোনো কাজ না করে, তাহলে ওই জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই।’
বিদ্যালয় সভ্যতার অগ্রগতিতে অবদান রাখে বলেও মন্তব্য করেন ড. জাহিদ হাসান। পাশাপাশি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ
দেন, শিক্ষার্থীরা তাদের মা-বাবার চেয়ে ভালো কিছু করছে কিনা– এ বিষয়ে মনোযোগী হতে। তিনি বলেন, যদি এটি না হয়, তাহলে তা অগ্রগতির লক্ষণ নয়।
ড. জাহিদ হাসান অনুষ্ঠানে তাঁর প্রয়াত বাবা রাজনীতিক মো. রহমত আলীর স্মৃতিচারণ করেন। মো. গোলাপ মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ড. জাহিদের ভাই গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জামিল হাসান দুর্জয়, শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র মো. আনিছুর রহমান, মো. আহসান উল্লাহ, সুলতান উদ্দিন মেমোরিয়াল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সালাহ উদ্দিন আহমেদ মিলন প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন শাহীন আহমেদ জিয়া।




বাধা যখন দুর্নীতি

‘প্রবৃদ্ধি-উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ’ শীর্ষক সমকালে ৭ জানুয়ারি প্রকাশিত ড. আতিউর রহমানের নিবন্ধটি আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর সরকারের কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের চিত্র তুলে ধরেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের দেশ ডিজিটাল থেকে স্মার্ট হিসেবে গড়ে উঠবে। এটি নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত।
স্মার্ট সরকার ব্যবস্থায় সরকারের সব সেবা স্মার্ট পদ্ধতিতে হতে হবে, যেখানে কোনো ভোগান্তি ও হয়রানি থাকবে না। কিন্তু ডিজিটাল হওয়ার পরও আমরা কতটা সুষ্ঠুভাবে সেবা পাচ্ছি? শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ স্মার্ট করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা এখন চরম বিপর্যয়ের মধ্যে। দেশে মেধার চর্চা নেই বললেই চলে, রয়েছে শুধু নম্বর চর্চা।
এ ছাড়া যে বিষয়ে পড়াশোনা, সে বিষয় সংক্রান্ত চাকরির সুযোগ হাতেগোনা কয়েক জায়গায়। এই যে এক বিষয়ে পড়াশোনা করে অন্য বিষয়ে চাকরি করছি, এতে আমার অর্জিত বিশেষায়িত জ্ঞানের কোনো মূল্যায়ন হবে না। অসুস্থতায় যেন ঘরে বসেই অফলাইন ক্লাসের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের সাইবার নিরাপত্তার জায়গা আগের চেয়ে কিছুটা উন্নত হয়েছে। আমাদের বাধ্যতামূলক আইসিটি শিক্ষার প্রচলন করতে হবে। কেননা, জাতি প্রযুক্তিতে দক্ষ না হলে কোনো কিছুতেই দক্ষ হবে না। স্কুল পর্যায়ে সরকার শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করে দিলেও বিদ্যালয়ের কোনো কোনো শিক্ষক সেখানে অবৈধভাবে বাণিজ্যিক কোর্স করিয়ে থাকেন! এ ক্ষেত্রে আইটি কোর্স হওয়া উচিত বিনামূল্যে। সরকারি প্রকল্প ও নিয়োগের কথাও আলোচনায় আসতে পারে। বেশিরভাগ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে। যার অর্থ একদিকে কাজে গাফিলতি, অন্যদিকে টাকা আত্মসাৎ। এ ছাড়া চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়া হতে হবে অল্প সময়ে; কোনো ভোগান্তি ছাড়াই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যেমন স্মার্ট কর্মকর্তা খোঁজা হয়, সরকারি নিয়োগেও চাই মেধার সঙ্গে স্মার্টনেসের সমন্বয়।
জাজিরা, শরীয়তপুর




নতুন মুদ্রানীতি কী করতে পারবে?

বাংলাদেশের মতো অনেক বিকাশমান অর্থনীতিতেই কভিড-পরবর্তীকালে, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মূল্যস্ম্ফীতি অনেকটা প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে নীতিভ্রম, আর্থিক খাতে তারল্য সংকট, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা, এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতায় সুশাসনের অভাব সাধারণ মানুষের জীবনমানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। নিম্ন সুদহার যেমন ক্ষুদ্র আমানতকারীদের নিরুৎসাহিত করছে, সেই সঙ্গে নিম্ন সুদে ভুল খাতে টাকা গিয়ে ঋণখেলাপি সংস্কৃতিকে চরমভাবে উৎসাহিত করছে।

আগেই যেমনটি বলেছি, শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রায় সারাবিশ্বে এক নম্বর সমস্যা এখন মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। বাংলাদেশে আবার ডলারের সংকটও এক বিরাট সমস্যা। সমস্যার সমাধানে মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জিনিসপত্র অতিরিক্ত ক্রয় নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যাতে মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য না কেনে। অন্যদিকে পণ্যের জোগান বাড়িয়ে ফেলা যায়।

এ দুটি ব্যবস্থা দিয়ে সাধারণত যে কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বাজারে যে পরিমাণ অতিরিক্ত তারল্য থাকে, সেটি ধীরে ধীরে কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। সারাবিশ্বে তা-ই ঘটছে। এখন মানুষের চাহিদা বেড়ে গেছে। এই অতিরিক্ত চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটি করতে হলে অন্য অনেক দেশের মতো নীতি সুদহার বাড়াতে হবে।

এটিও আবার মনে রাখতে হবে- এ সময়ের মূল্যস্ম্ফীতি হলো অনেকটা আমদানি করা মূল্যস্ম্ফীতি। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ব্যবস্থাপনাও খুব জরুরি। আমাদের দেশে একাধিক বিনিময় হার আছে। সেটিকে একটি বিনিময় হারে আনা যায় কিনা ভাবতে হবে।

যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করছে বলে কিছুদিন ধরে শোনা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য এখনও দেখা যায়নি। আমাদের আমদানি অর্থবছরের গেল ছয় মাসে প্রায় ২২ শতাংশ কমেছে। রপ্তানিও বেড়েছে। তবে ডলারের সংকট কাটেনি। ঋণপত্র খোলা, এমনকি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য এখনও বিদেশে টাকা পাঠানো দুরূহ।

অনেকে মনে করেন, আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণই একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতিতে এটি হবে একটি উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বহু লক্ষ্য থাকতে হবে। এটি যেমন উৎপাদনশীল খাতের বিকাশে সাহায্য করবে, তেমনি জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবুজ অর্থায়নও জোরদার করবে।

বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ক্ষেত্রেও আরও দক্ষতা দেখাতে হবে। সাম্প্রতিককালে মুদ্রানীতি নিয়ে আলোচনায় ক্যানভাস অনেক বড় হয়ে গেলেও, অনেকেই সব মিলিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ মুদ্রানীতি চেয়েছেন। অনেকেই এটিকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বলতে নারাজ। বলছেন, উন্নয়ন সমর্থক একটি ভারসাম্যপূর্ণ মুদ্রানীতি। যেখানে মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এবং উন্নয়নকে সমর্থন করা হবে।

জানা কথা, আমাদের অর্থনীতির সামনে মূল্যস্ম্ফীতি আর ডলারের সংকট বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের এই মন্দার ধাক্কা উন্নয়নশীল বিশ্বেও পড়ছে এবং আরও পড়বে। যেসব অর্থনীতির দেশ রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল, তারা আরও বেশি মন্দার কবলে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যেমনটি বলেছি, আমরা ডলারের সংকট মোকাবিলার জন্য এ পর্যন্ত আমদানিকে চেপে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু এটিও জানা, আমদানিকে এভাবে চেপে রাখলে নিকট ভবিষ্যতে উৎপাদন ব্যাহত হবে। এমনকি রপ্তানি খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই একে বেশিদিন জোর করে চেপে রাখা যাবে না। এ নীতি থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বের হতেই হবে।

বর্তমানে একটি মুদ্রানীতি চলমান। এখন দেখার বিষয় অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে যা ঘটেছে, বিশেষ করে মূল্যস্ম্ফীতির ক্ষেত্রে, তার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাকি ছয় মাসের জন্য নীতিতে কী কী পরিবর্তন আনে। তাদের ভাবতে হবে করণীয় যতটুকুই হোক না, তাতে তারা কী করবে। এটিও সত্য, মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কোথাও শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে না।

পত্রিকান্তরে জানা গেছে, সরকারের ঋণগুলো পুরোপুরি অর্থায়ন হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এবং এর পরিমাণ ইদানীংকালে বিরাট অঙ্কে বেড়েছে। যা টাকা ছাপিয়ে করা হয়েছে। ফলে রিজার্ভ মানির পরিমাণ বেড়ে যায়, যদিও এর প্রভাব এখনও মূল্যস্ম্ফীতির ওপর বিরাটভাবে পড়েনি। একটি কারণ হয়তো একদিকে যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে টাকা দিয়েছে, অন্যদিকে বড় অঙ্কের ডলার বিক্রি করেছে। বিপরীতে প্রচুর টাকা ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে এসেছে। মোট মুদ্রা সরবরাহের ওপরে তেমন প্রভাব পড়েনি। কিন্তু ডলার বিক্রি বাংলাদেশ ব্যাংক আর বেশি দিন করতে পারবে না। রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। সরকারের ঋণও ব্যাপকভাবে বাড়ছে। তাই বাজেট ঘাটতিতে যে অর্থায়ন করা হচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক আমলে না নিলেও আমরা কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার বারবার বলছি- মুদ্রানীতিকে মূল্যস্ম্ফীতির কাজে ব্যবহার করতে হলে সুদহারের ওপরে যে ক্যাপ বা সীমা আছে, তা তুলে দিতে হবে। সুদহারের সীমা যদি বাজার বা মূল্যস্ম্ফীতির হারের অনেক নিচে থাকে, তাহলে মুদ্রানীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করবে কীভাবে? মুদ্রানীতি মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজে আসে তখন, যখন সুদহার ওঠানামা করার সুযোগ থাকে।

এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো রেট দুই দফা বাড়িয়েছে। এটি বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই, যদি ঋণের সুদহার অপরিবর্তিত থাকে। ব্যক্তিঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক পরোক্ষভাবে কিছুটা ছাড় দিয়েছে। যদিও এটির কোনো ঘোষণা বা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। সব ব্যাংক তো একভাবে মৌখিক নীতি অনুসরণ করতে পারে না। এ ধরনের মৌখিক নীতি অনেকটাই অস্বচ্ছ, এমনকি ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই এটির ওপর ভরসা করতে পারছে না অনেক ব্যাংক।

বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে যে বিভিন্ন হার চলছে, সেটিও চলতে পারে না। এটি ডলারের তারল্যে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারবার বলছে, তারা ভাসমান নীতিতে চলে আসবে। কিন্তু আসছে না। ভাসমান নীতি গত বছরের মার্চের আগেও কার্যকর ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয়তো বলতে পারে- এটি তো আমরা করিনি, করেছে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা)। তবে প্রায় সবাই মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের আশীর্বাদেই বিভিন্ন বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়েছে। এটিও তেমনি আরেকটি অঘোষিত নীতি।

নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এত লুকোচুরি রেখে আর দু-একজনের মেধার ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে মুদ্রানীতি কার্যকর করবে- সেটিই হবে দেখার বিষয়।

মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্নেষক




রাহুলের যাত্রায় মোদি-উত্তর ভারতের ইঙ্গিত দিচ্ছে

ভারতের স্বাধীনতার নায়ক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সুস্পষ্ট অনুকরণে দেশটির প্রধান বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী বর্তমানে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলমান পদচারণার শেষ পর্যায়ে আছেন। সমালোচক ও সংশয়বাদীদের উপেক্ষা করে তাঁর কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারেরও বেশি হেঁটে অতিক্রমের এ যাত্রা স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও জনসমাবেশের দিক থেকে সফল হয়েছে। তিন মাস ধরে ভারত জোড়ো যাত্রা বা ভারতের ঐক্যের জন্য এ পদযাত্রা সচেতন মানুষদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি করেছে।

পদযাত্রাটি মঙ্গলবার রাতে উত্তরের পাঞ্জাব রাজ্যে প্রবেশ করেছে। এ পথেই এটি তার সমাপ্তি টানতে ভারত শাসিত কাশ্মীরের উচ্চশিখরে পৌঁছবে। এত দীর্ঘ পথ চলতে গিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মুখ রাহুল বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রকে একটি নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিচ্ছেন; প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ বা হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথরেখাও তৈরি হচ্ছে এ পদযাত্রায়।

যাত্রা শব্দটি ভারতে সাধারণত হিন্দু তীর্থযাত্রা বোঝাতে ব্যবহূত হয়। তবে রাহুলের এ যাত্রার লক্ষ্য রাজনৈতিক মুক্তি। এটি কংগ্রেস দলকে পুনরুজ্জীবিত করেছে, যাঁকে ধারাবাহিক নির্বাচনী পরাজয় এক দশক ধরে প্রায় স্থবির করে রেখেছিল। বিজেপি যাঁকে বরাবর অপেশাদার রাজনীতিবিদ হিসেবে আখ্যায়িত শুধু নয়, নির্দয় উপহাসও করে আসছে; সেই রাহুল আজ গণআবেদনধারী একজন নেতা হিসেবে আবির্ভূত।

আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি এবং সবার জন্য সমৃদ্ধির একটি সহজ বার্তা নিয়ে চলমান এ মহাকাব্যিক পদযাত্রার মূল মনোযোগ হলো সাধারণ মানুষের সঙ্গে জঙ্গমক্রিয়ার ওপর। প্রতিদিন প্রতিটি যাত্রাবিরতিতে রাহুলের সহকারীরা তাঁদের নেতার সঙ্গে কৃষক ও শ্রমিক, যুবক ও বৃদ্ধ, পুরুষ ও নারী, এমনকি শিশুদের সঙ্গেও মোদি সরকারের অধীনে তাদের ছিন্নভিন্ন স্বপ্ন সম্পর্কে যে কথোপকথন হয়, তা নথিবদ্ধ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। এগুলো ভারতীয় অর্থনীতির জীবন্ত বাস্তবতার খণ্ড খণ্ড চিত্র তুলে ধরে; যেখানে উচ্চ বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ম্ফীতির কথা উঠে আসে। যে সরকারের আমলে এটা ঘটছে, সে প্রতিশ্রুতিতে চ্যাম্পিয়ন হলেও তার বাস্তবায়নে খুবই দুর্বল।

রাহুল গান্ধীর বার্তা হলো- মোদির প্রবল হিন্দুত্ব ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্ভাবনাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এসব বার্তার পাশাপাশি দাড়িওয়ালা বিরোধী নেতার সঙ্গে মানুষের আলিঙ্গন ও সেলফির জন্য হুড়াহুড়ি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের পাশাপাশি মিডিয়াতেও নতুন এক ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করেছে, যা এতদিন ছিল মোদির একচেটিয়া দখলে। আট বছর আগে ক্ষমতায় আরোহণের পর এই প্রথম মোদি এক ধরনের নীরবতা পালন করছেন। রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রা নিয়ে কিছুই বলছেন না তিনি।

রাজনৈতিক এ বার্তা প্রকৃতপক্ষে বহুসংস্কৃতি বা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি এবং হিন্দু আধিপত্যবাদী নীতির মধ্যে সংঘর্ষের কথা বলছে। কিন্তু এটি স্পষ্ট- এ পদযাত্রা সেই যুদ্ধের কাঠামো তৈরি করে দিয়েছে; যার এক প্রান্তে আছেন একজন, যিনি ভারতীয়দের চাঙ্গা করছেন এবং অপর প্রান্তে আছেন তিনি, যিনি তাঁদের বিভক্ত করছেন।

মোদি ও বিজেপি দীর্ঘকাল ধরে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে আসছে; যে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কার্যত প্রতিনিধি গান্ধী পরিবার। ওদের বক্তব্য হলো, গান্ধী পরিবার ভারতকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও ক্ষয়িষুষ্ণ করে দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে দেশটিকে বিশ্বব্যবস্থায় তার যোগ্য স্থান থেকে বঞ্চিত করেছে। রাহুল গান্ধীর প্রমাতামহ জওহরলাল নেহরু, দাদি ইন্দিরা গান্ধী এবং বাবা রাজীব গান্ধী- সবাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এসব জপেই মোদি ২০১৪ ও ‘১৯ সালের নির্বাচনে বিশাল ম্যান্ডেট পেয়ে যান এবং বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি যুক্ত রাজনৈতিক অভিজাতদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকে ব্যবহার করে তাঁর সহিংস হিন্দুত্বকে আড়ালের সুযোগ তৈরি করেন। মোদি নিজেকে একজন শক্তিশালী কিন্তু জনতুষ্টিবাদী হিসেবে তুলে ধরেছেন, যিনি এই তথাকথিত প্রাচীন শাসনের বিরুদ্ধে উঠে এসেছেন। বর্তমানে আইন থেকে রাজনৈতিক বক্তৃতাবাজি- সবখানেই মোদি ভারতের জন্য একটি আগ্রাসী ‘হিন্দু প্রথম’ এজেন্ডা মূর্ত করে চলেছেন। নাগরিকত্বে ধর্মীয় বৈষম্য প্রবর্তনকারী প্রস্তাবিত আইন থেকে শুরু করে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নিয়মিত সহিংসতা- সবখানে মোদির এজেন্ডা হলো, ভারতকে ঢেলে সাজিয়ে একটি মাত্র সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটানো।

৫২ বছর বয়সী রাহুল গান্ধী দীর্ঘদিন ধরে একটি রাজবংশের চতুর্থ প্রজন্ম হিসেবে নিন্দিত হয়েছেন। তবুও বিশেষত তাঁর পারিবারিক ইতিহাসের কারণে ক্ষমতা ও সহিংসতা সম্পর্কে রাহুলেরই দীর্ঘ ও নিবিড় জ্ঞান রয়েছে। তাঁর দাদি ও বাবা দু’জনকেই হত্যা করা হয়। রাজনৈতিক পদ-পদবি ও ক্ষমতার ফাঁদ এড়িয়ে জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন, মোদির শক্তিশালী কৌশলগুলো সফলভাবে মোকাবিলা তখনই করা যাবে যখন এসব অপকৌশলের ভুক্তভোগী মানুষ একসঙ্গে দাঁড়াবে এবং হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে সামান্যতম সমালোচকদেরও- যাঁরা এ হিন্দুত্বের কারণে জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন; এক ছাতার নিচে আনা যাবে।

মোদি কর্তৃত্ব ও জনতুষ্টিবাদের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রকাশ করে চলেছেন। অন্যদিকে রাহুল জনগণের সঙ্গে একটি সহানুভূতিশীল সংযোগ তৈরি করতে চাচ্ছেন। ভারতের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে একটি আনুভূমিক মৈত্রীর সন্ধানরত এ যাত্রার বার্তা হলো- নির্ভীকতার রাজনীতিকে শক্তিশালীকরণ। এটি করার মাধ্যমে যাত্রা স্বাধীন ভারতের ভিত্তি বলে পরিচিত বৈচিত্র্য ও ন্যায্যতার নীতিগুলোকে পুনঃআবিস্কার করতে চায়। লক্ষণীয়, এ যাত্রা সহিংসতা এবং পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির প্রভাবশালী আখ্যানকে ভোঁতা এবং মোকাবিলা করার জন্য প্রেম, মৈত্রী ও ত্যাগের মতো আবেগধর্ম এক সহজ রাজনৈতিক চিত্রনাট্যের ওপর জোর দিয়েছে।

প্রায় এক শতক আগে জাতির পিতা গান্ধীর বিখ্যাত লবণ যাত্রা (সল্ট মার্চ) ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং ভারতীয় রাজনৈতিক অভিজাতদের একইভাবে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। কারণ তিনি রাজনৈতিক পদ-পদবি ও ক্ষমতা পরিত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু সাধারণ ভারতীয়দের সাহসী আশায় আলোকিত করেছিলেন। তিনি রাজনীতির রূপান্তর এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞা খুঁজছিলেন। নিঃসন্দেহে তিনি তাতে সফল হয়েছিলেন।

দুই গান্ধীর মধ্যে তুলনা করা হলে তা নিশ্চয়ই হাস্যকর ও বোকামি হবে। আজকের প্রতিযোগিতা কোনো বিদেশি সাম্রাজ্যিক শক্তিকে উৎখাত করা নিয়ে নয়। এটি ভারতের ভবিষ্যৎ পরিচয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ ও নিবিড় পছন্দ-অপছন্দের বিষয়।

কিন্তু মোদি ও বিজেপির দেখানো পথের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পথ দেখানোর মাধ্যমে ভারত জোড়ো যাত্রা ২০২৪ সালের নির্বাচনী যুদ্ধে লড়ার একটি মোক্ষম কৌশল পেতে সাহায্য করেছে। প্রায় এক দশক ধরে মোদি ও হিন্দুত্ব দ্বারা আচ্ছন্ন থাকার পর ভারতীয় গণতন্ত্র শেষ পর্যন্ত আদর্শ, আবেগ ও ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিক একটি সত্যিকারের প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বলে মনে হয়।

স্রুতি কাপিলা: ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ইতিহাস ও রাজনীতিবিষয়ক অধ্যাপক; আলজাজিরা ডটকম থেকে ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন




ইউজিসি নিধিরাম সর্দার থাকবে না!

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি দেশের উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকলেও সংস্থাটির হাতে বিচারিক ক্ষমতা অর্থাৎ শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা নেই বললেই চলে। তাই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে আইনগত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করেছে ইউজিসির চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। বর্তমানে ইউজিসি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়ম তদন্ত করা ও তাদের কার্যক্রমের তদারকি করতে পারে। অবস্থার আলোকে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করে এবং সে আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া না নেওয়ার এখতিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। অর্থাৎ ইউজিসির ভূমিকা আমরা দেখছি অনেকটা ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দারের মতো।

প্রথম কথা হলো, ইউজিসি কেন বিচারিক ক্ষমতা চায়। যদি এমন হয়, কোনো বিষয়ে সুপারিশ করার পরও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে না, সেখানে ইউজিসির হাতে থাকলেও সংস্থাটি সে ব্যবস্থা নিতে পারবে কিনা। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে না পারলে ইউজিসিও যে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে- এমনটি ভাবার কারণ নেই। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে যারা রয়েছে স্বাভাবিকভাবেই তারা ক্ষমতাবান এবং সাধারণত তারা ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকে। ফলে সেখানে অনেকক্ষেত্রে ইউজিসি কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় অসহায়। এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যারা জড়িত তারাও কম শক্তিশালী নয়। ফলে সেখানেও সবসময় ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। 

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ ১২ বছরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি, প্রতিষ্ঠার ২০-২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখনও স্থায়ী ক্যাম্পাসে যায়নি। স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য তাদের ইউজিসির পক্ষ থেকে বারবার নোটিশ দেওয়ার পরও অনেকেই তা বাস্তবায়ন করেনি। অনেকেই আবার দূরে নামকাওয়াস্তে ক্যাম্পাস বানিয়ে রাজধানীতেই শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইউজিসির পক্ষ থেকে হয় স্থায়ী ক্যাম্পাস, না হয় শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ- এমন বার্তা দেওয়ার পরও নিয়ম মানছে না অনেকেই। এরপরও কিন্তু তাদের শিক্ষা কার্যক্রম দিব্যি চলছে। এখনও অন্তত একডজন বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে যায়নি। ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়- কেউই এদের নিয়ন্তণে আনতে পারেনি।

সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম, অতিরিক্ত ছাত্র ভর্তি, সনদ বাণিজ্য, আর্থিক অনিয়ম ঠেকাতে আইনি ব্যবস্থা অবশ্যই থাকা জরুরি। বিদ্যমান ব্যবস্থায় এর এখতিয়ার মূলত শিক্ষা মন্ত্রাণালয়ের হাতে। ইউজিসি কোনো বিষয়ে সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠালে, দেখা যায়, সেখানে বিষয়টি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে যায়। ফলে অনিয়ম থেকেই যাচ্ছে। সেদিক থেকে ইউজিসির হাতে ক্ষমতা থাকলে সংস্থাটি ত্বরিত যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। ইউজিসির জন্য এটি সহজ এ কারণে বিষয়টির তত্ত্বাবধানে সরাসরি সংস্থাটিই করেছে। কোনো বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে সিদ্ধান্তের সুপারিশ করলে তারা আবার তদন্তে গেলে অযথা সময় নষ্ট হবে।

শুক্রবার সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, কেবল বিচারিক ক্ষমতাই নয় উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে উপাচার্য নিয়োগে নীতিমালা প্রণয়ন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বয়স ও সময়ের বাধ্যবাধকতা শিথিল করা, অভ্যন্তরীণ র‌্যাঙ্কিং ব্যবস্থা চালু করাসহ ইউজিসি ১৭টি সুপারিশ করেছে। সময়ের আলোকে এগুলো নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন তখনই হতে পারে, যখন দেশে উচ্চশিক্ষার মূল সংকট দূর হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সংকট এখন সর্বগ্রাসী দলীয়করণ। যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষক নিয়োগ কিংবা উপাচার্য নিয়োগে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দলীয়করণ দূর না হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে ক্ষমতা থাকা আর ইউজিসির হাতে ক্ষমতা থাকার মধ্যে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য নেই। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সংকট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যেমন বের হতে পারবে না তেমনি উচ্চশিক্ষার সংকটও কাটবে বলে মনে হয় না।




এই শক্তি ও অনুপ্রেরণা ইতিহাসের দান

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরো সময়ের মধ্যে ডিসেম্বর মাসটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ মাসেই ঘুরে যায় যুদ্ধের মোড়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দখলমুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ৫ ডিসেম্বর ছিল রোববার। সর্বাত্মক লড়াইয়ে এদিন শত্রুমুক্ত হয় বাংলার আকাশ। মিত্রশক্তির বিমানবাহিনী ঢাকার আকাশ পুরোপুরি দখলে নেয়। সারা দিন ভারতীয় জঙ্গিবিমান পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলোয় প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। অকেজো করে দেয় বিমানবন্দরগুলো। এর একদিন পরই ভারত সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজয়ের খবর আসতে থাকে। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে রয়েছে নানা মোড়। আজও ছড়িয়ে আছে যুদ্ধের অনেক না জানা ইতিহাস, ত্যাগরে কাহিনি।

মহান মুক্তিসংগ্রামে অনন্য ভূমিকা পালন করেন গবেষক, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি এখনো আমাদের হানা দেয়। যখন পেছনদিকে তাকাই, তখন অনেক কথাই মাথায় ঘুরপাক খায়। একটি স্মৃতি সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা পেল। আমরা এই জাদুঘরের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি।

এই জাদুঘর সর্বজনের সমর্থন পেয়ে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই জাদুঘর করার পেছনে যে চ্যালেঞ্জ ছিল, তা হলো উপকরণ আহরণ ও সংরক্ষণ করা। আর সে দায়িত্ব আমরা পালন করছি। আমার খুব মনে পড়ে নিজামউদ্দিন আজাদের কথা। ১৯৭১ সালে সে ছিল আমাদের অনুজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ছোট ভাই। মিটিংয়ে, মিছিলে আজাদ সব সময় সামনের সারিতে থাকে। সব সময় স্লোগান দেয়, দেখতে সুদর্শন। আজাদের বাবা কামরুদ্দিন আহমেদ বিশিষ্ট আইনজীবী। অনেকভাবে আজাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে আমরা একত্রে থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেদিন রাতে যে আক্রমণ হলো তাতে প্রতিরোধের প্রয়াসগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমরা নানাদিকে ছড়িয়ে পড়ি। তারপর কারফিউ উঠল অল্প সময়ের জন্য। প্রথমদিন সম্ভবত ঘণ্টা দুয়েকের জন্য এবং তারপর আরেকটু বাড়তি সময়। দ্বিতীয়বারের জন্য যখন কারফিউ উঠল, তখন আজাদ এসেছিল আমার বাসায়। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করছিলাম। আজাদ ছোট্ট রুমালে বাঁধা একটা পুঁটলির মতো নিয়ে এসেছিল। আমাকে বলল, সে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, জগন্নাথ হলে পাকিস্তানি বাহনীর হত্যাযজ্ঞ নিজে দেখে এসেছে।

গিয়েছিল শিববাড়ীতে যে কোয়ার্টারে মধু দাকে হত্যা করা হয়। ও দুই ঘণ্টায় যখন কারফিউ শেষ হলো, সে তখনই ওখানে যায়। মধু দার ফ্ল্যাটেও সে ঢুকেছিল। সেখানে রক্তের চিহ্ন, দেওয়ালে বুটেলের চিহ্ন দেখেছে। সেখান থেকে কয়েকটা বুলেটের খোসা তুলে এনেছিল। সেটাই রুমালে করে নিয়ে এসে আমাকে দেখাল। এখন মাঝেমধ্যে মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করার যে প্রয়াস আমরা ২৫ বছর পরে নিয়েছিলাম, সেই কাজটা সে ২৫ মার্চের পরই শুরু করেছিল। সেই আজাদও ১১ নভেম্বর শহিদ হলো। এ স্মারকগুলো যখন দেখি, তখন স্মৃতিকাতর হই, একধরনের আকুলতা কাজ করে। সব মিলিয়ে মনে হয়, আজাদের কাজটাই যেন আমরা এখন করছি। আজাদ নেই; কিন্তু তবুও যেন আজাদ আছে আমাদের সঙ্গে।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর আজাদের লাশ পাওয়া যায়নি। কেনো আনুষ্ঠানিক দাফনও হয়নি। এরকমভাবে যারা হারিয়ে গেছে, তাদের মায়েরা কিন্তু আশা ছাড়েননি। আজাদের মা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আশা ছাড়েননি, অপেক্ষা করেছেন। তার ছেলে বেঁচে আছে এবং ফিরে আসবে।

মফিদুল হক বলেন, এই যে একটা অসাধারণ লড়াই এবং তার পরতে পরতে এতকিছু জড়িয়ে আছে, সেটা যেন বহমান থাকে। নবীনরা যেন এটা অনুধাবন করতে পারে। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে তারা নিজেরাই শক্তি খুঁজে পাবে। বহু বাধা চড়াই-উতরাই তো জীবনে থাকেই। কিন্তু এই যে একটা প্রেরণা এবং শক্তি, যা আমাদের ইতিহাস আমাদের জুগিয়েছে। আমরা যেন এই ইতিহাসের প্রতি অবহেলা না করি এবং শক্তিটা যেন ধারণ করার চেষ্টা করি।




শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা ও আমাদের করণীয়

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের মাঝে দু’টি সত্তা বিরাজমান। একটি জীবসত্তা বা পশুত্ব অপরটি মানবসত্তা বা মনুষ্যত্ব। জীবসত্তার একমাত্র লক্ষ্য হলো ক্ষুৎপিপাসায় কাতর মানুষটিকে উদর পুর্তি ও জৈবিক চাহিদা নিবারণের মাধ্যমে তৃপ্ত রাখা।

অপরদিকে মানবসত্তার কাজ হলো নিজেকে জানা। কিসে মানব জন্মের স্বার্থকতা এ চিন্তায় ভাবিয়ে তোলা। এ ভাবিয়ে তোলার পিছনে যে প্রধান ভূমিকা পালন করে তা হলো শিক্ষা।  আর সুশিক্ষার মাধ্যমে জীবসত্তা মানবসত্তায় উন্নীত হতে সক্ষম হয়।

শিক্ষা শব্দটি ব্যুৎপত্তি বিশ্লেষণে জানা যায়, শিক্ষা শব্দটি ‘শাস’ ধাতু হতে নির্গত।  যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা। ‘শিক্ষা’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Education. Education শব্দটি educare বা educatio থেকে গঠিত। যার অর্থ বের করে আনা। ব্যাপকার্থে ভিতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা।অর্থাৎ ব্যক্তির সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলনই শিক্ষা।  যুগে যুগে দার্শনিকগণ শিক্ষাকে সজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে-

★ গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের ভাষায়, “শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।”

★ এরিষ্টটলের মতে, “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা।”

★ কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “মানুষের অন্তর্নিহিত বিকাশই হলো শিক্ষা।

★ স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, ” উঠো; জাগো, নিজে জেগে অপরকে জাগাও।”

 সত্যিই শিক্ষা মানুষের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলে এবং কিসে মানব জীবনের স্বার্থকতা, সে গান শোনায়।

শিক্ষার বিকাশ কাল নিয়ে জানা যায়, নিয়ম মাফিক শিক্ষা তথা স্বাক্ষরীকরণ গত দেড়শো-দ’শো বছরের সমাজে পরিবাহিত হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার, যা ১৯৬৬ সালে সার্বজনীন অধিকার হিসেবে জাতিসংঘ স্বীকৃতি প্রদান করে। এবার নৈতিক শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা যাক।

নৈতিক শিক্ষা (Moral Education)

নৈতিক শব্দটি প্রত্যয় নিষ্পন্ন শব্দ। ‘নীতি’ প্রকৃতির সাথে ‘ইক’ প্রত্যয় যোগে ‘নৈতিক’ শব্দটির সৃষ্টি। এর অর্থ নীতি সম্বন্ধীয় বা নীতি সংক্রান্ত। নৈতিক শিক্ষা বলতে বোঝায় জীবনের ভালো ও সঠিক নীতি অনুসরণের নীতিগত অধ্যয়ন বা পাঠ গ্রহণ করা।  আরো সহজ করে বলা যায়, যে শিক্ষা আমাদের মনে নীতিবোধ জাগ্রত করে তা-ই নৈতিক শিক্ষা।

নৈতিক শিক্ষা মূলত কিছু মানবিক মূলনীতি নিয়ে গঠিত। নৈতিক শিক্ষা একজন মানুষকে মানবিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধ করে স্বার্থক মানুষের মর্যাদায় আসীন করে। এ শিক্ষায় সমৃদ্ধ মানুষ নিজেদের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি অপরের অধিকার ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি যত্নবান হন। তাই শৈশব থেকেই শিশুকে নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে বিকশিত করতে অভিভাবকদের সচেষ্ট হওয়া উচিৎ।

নৈতিক শিক্ষা ইসলামি বিষয়াবলির অন্তর্গত। ইসলামি দর্শনের আদি শিক্ষক হলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। তার স্বাক্ষ্য হিসেবে ফেরেশতারা বলেছিলেন “হে আল্লাহ, আপনি পবিত্র। আপনি যা শিখিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের কোনই জ্ঞান নেই। নিশ্চয়ই আপনি মহাজ্ঞানী ও কোশলি। (আল-কোরআন)

মানব জাতির পথ প্রদর্শক মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সঃ) এর প্রতি মহান আল্লাহ তায়ালার প্রথম নির্দেশ ছিল, ” পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। (আল-কোরআন) নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি নিজেকে জানার চেষ্টা করে। কিসে মানব জন্মের স্বার্থকতা,  তা বাতলিয়ে দেয়।

আলোচনার প্রান্তিক পর্যায়ে এসে জিজ্ঞাস্য আমরা যে গতানুগতিক শিক্ষা লাভ করছি তার সাথে নৈতিক শিক্ষার সম্পর্ক কতটুকু? এ সিলেবাস ভিত্তিক শিক্ষা কি আমাদের পরমত, পরধর্ম সহিষ্ণু করে গড়ে তুলতে সাহায্য করে? যদি করেই থাকে, তাহলে মানবিক মুল্যবোধ এত লোপ পেয়েছে কেন? কেন জীবসত্তা তথা পশুত্বের এমন জয়জয়কার? মানবসত্তা বা মনুষ্যত্ব কেন অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে? সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী ব্যক্তিটি কেন লুটেরা হচ্ছে? আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি এ নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য সিলেবাস প্রণেতারা কিয়দংশ দায়ী। কোমলমতি শিশুদের পাঠ্য নির্বাচনে উনারা আরো সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়। এক সময়ের পাঠ্য ওস্তাদের কদর, জীবন বিনিময়  সৎসঙ্গ কবিতা পাঠ শিক্ষার্থীর মন-প্রাণ আন্দোলিত হতো। বর্তমান পাঠ্য সাহিত্য পাঠে কি আমাদের মন সেভাবে প্রভাবিত হয়? পাঠ্য নির্বাচকরা এমন বিষয়াবলি সংযোজন করা উচিৎ, যা পাঠে শৈশব থেকেই শিশুরা নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মানবিক গুণাবলিতে বলিয়ান স্বার্থক মানুষে পরিণত হয়ে দেশ, জাতির কল্যাণে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ পায়।

মোঃ ইয়াছিন

প্রভাষক বাংলা

হাজিরহাট হামিদিয়া ফাযিল ডিগ্রি মাদরাসা




আসুন আল্লাহকে ভালোবাসি   

কল্পনা করুন একজন মানুষের সাথে আপনার দেখা হলো।তাকে আপনি চেনেন না। দেখা হওয়া মাত্রই আপনি তাকে একটি মুচকি হাসি উপহার দিলেন। এরপর লোকটির কথা ভুলেই গেলেন। কিন্তু কিছু দিন পরে দেখলেন সেই ব্যক্তি আপনাকে একটি গাড়ি উপহার দিয়ে বলল, ‘আমি আপনার সে হাসির কথা কিছুতেই ভুলবো না। সে হাসিতে আমার প্রতি আপনার সত্যিকারের ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি।’

 এরপর আপনার সে হাসির কারণে ঐ লোক সবসময় আপনার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে লাগল এবং আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে লাগল। আপনি একটা বিপদে পড়েছেন, সে এসে আপনাকে সাহায্য করল। এমনিভাবে তার সময়-শ্রম দিয়ে সবক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করল। যখন আপনি অসুস্থ হলেন, সে এসে আপনাকে দেখে গেল এবং আপনার হাতে খাবার তুলে দিল।

তার এই অবস্থা দেখে আপনি বেশ লজ্জায় পড়ে গেলেন এবং তাকে বললেন যে, আমি তো এতকিছু পাওয়ার যোগ্য নই। সে উত্তর দিল, ‘না, না, আমি কখনোই আপনার সেই হাসির কথা ভুলতে পারব না। এভাবেই সে আপনার প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়ে যেতে থাকল। এর মধ্যে দুনিয়াবি কোন স্বার্থ নেই।

এই ধরনের মানুষকেই কিন্তু আপনি ‘ওয়াদুদ অর্থাৎ অতি দয়ালু বলে অভিহিত করবেন। এই ধরনের মানুষের দয়া দেখে আপনি প্রচন্ড লজ্জা অনুভব করবেন। বিশেষ করে যখন আপনি নিজে তার সাথে অনুরূপ কিছু করতে অক্ষম হবেন।

আল্লাহর ব্যাপারটিও এমনই। তিনি পরম দয়াময়। সামান্য আমলের বিনিময়ে তিনি তার বান্দাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন, তাদেরকে ভালোবাসেন এবং তাদের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র কাজেও অনেক বেশি সম্মান প্রদান করেন। হয়তো কাজটি বান্দার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তবুও তিনি তাকে এর বিনিময়ে বিরাট প্রতিদান দিয়ে থাকেন।তবে এই সকল কথা এ কাজের প্রতিদান পাওয়ার জন্য একটাই শর্ত। কাজটি কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই নিবেদিত হবে।

আপনি রাসূল সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিসের দিকে লক্ষ্য করতে পারেন। তিনি বলেছেন,

ان احدكم ليتكلم بالكلمت من رضوان االله ما يظن ان تبلغ ما بلغت فيكتب الله له بها رضوانه الى يوم يلقاه

“তোমাদের মধ্যে কেউ যখন আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির কথা বলে, যার সম্পর্কে সে ধারণাও করে না যে, তা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে। অথচ আল্লাহ তায়ালা তার এই কথার কারণে তাঁর সাথে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত তার জন্য সন্তুষ্টি লিখে দেন।” তিরমিজিঃ ২৩১৯

একটি ছোট্ট কথা হয়তো সে বলার পর ভুলেও গিয়েছে। সে কখনও এটা কল্পনাও করতে পারেনি যে, আল্লাহর কাছে তা এত বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এই কথার কারণেই তার ওপর অনেক বেশি সন্তুষ্ট হয়েছেন। কারণ তিনি পরম দয়াময়।

হাদিসে এসেছে,

لقد رايت رجلا يتقلب في الجنة، في شجرة قطعها من ظهر الطريق، كانت تؤذي الناس

“আমি এক ব্যক্তিকে দেখলাম জান্নাতে একটি গাছের নিচে স্বচ্ছন্দে হাঁটছে। কারণ সে এমন একটি গাছ রাস্তার মধ্য থেকে কেটে ফেলেছে যা মানুষ কে কষ্ট দিত।” মুসলিমঃ ১৯০৫

এটিও কত ছোট্র একটি কাজ! কিন্তু যেহেতু এটি করা হয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, তাই তিনি এর জন্য বিরাট বড় প্রতিদান দিলেন। আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি ভালো কাজকে দশ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেন। কারণ তিনি পরম দয়াময়।

যদি আল্লাহর দয়া এবং তার সহিষ্ণুতা নিয়ে চিন্তা করার কারণে আপনার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, তবে এই ক্ষুদ্র কাজের বিনিময়েও কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা আপনাকে আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন এবং জাহান্নামকে আপনার জন্য হারাম করে দেবেন। কারণ তিনি পরম দয়াময়।

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,  সাত শ্রেণির ব্যক্তিকে আরশের ছায়া তলে আশ্রয় দেয়া হবে। তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হলোঃ

رجل ذكرالله خاليا، ففاضت عيناه

“এমন ব্যক্তি, যে কি না নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে। আর এতে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়।” বুখারিঃ ১৪২৩

আরেক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

عينان لا تمسهما النار. عين بكت من خشية الله، وعين باتت تحرس في سبيل الله.

“দুটি চোখ জাহান্নামের সংস্পর্শে আসবেনা। এক. যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে। দুই. যে চোখ আল্লাহর পথে পাহারা দিতে গিয়ে নির্ঘুম রাত কাটায়।” তিরমিজিঃ ১৬৪৫

কাজগুলো কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র! কিন্তু আল্লাহতায়ালা এগুলোকে যথাযথ মূল্যায়ন করেন। কারণ তিনি বান্দার কাজের যথাযথ পুরস্কার দিয়ে থাকেন। বান্দা যখন তাঁর জন্য নেক কাজ করে, তখন তিনি তার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করেন। তিনি বলেছেন,

واستغفروا ربكم ثم توبوا اليه ان ربي رحيم ودود

“তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তাঁর কাছে তাওবা করো। নিশ্চয়ই আমার রব দয়ালু এবং দয়াময়।” সূরা হুদঃ ৯০

তিনি আপনার পাহাড় পরিমাণ গুনাহকে ক্ষমা করে দিচ্ছেন এবং এত বিশাল গুণাহ ক্ষমা করতে গিয়ে তিনি অন্যকিছুর ভ্রুক্ষেপও করছেন না। কারণ ছাড়া একবিন্দু নেকিও তিনি বিনষ্ট করেন না। তিনি বলেছেন,

ان الله لا يضيع اجر المحسنين

“নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সৎ কর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।” সূরা তাওবাঃ ১০২

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

من جاء بالحسنة فله عشز امثالها وازيد، و من خاء بالسيئة فجزاؤه سيءة مثلها او اغفر ومن تقزب مني شبرا تقربت منه ذراعا، ومن تقرب مني ذراعا تقربت منه باعا، ومن اتانى يمشي اتيته هرولة، ومن لقيني بقراب الارض خطيئة لا يشرك بي شيئاا لقيته بمثلها مغفرة.

“যে ব্যক্তি একটি নেক কাজ করবে, তার জন্য রয়েছে দশগুণ সাওয়াব; আর আমি তাকে আরও বাড়িয়ে দেব। আর যে ব্যক্তি একটি মন্দ কাজ (গুনাহ) করবে তার প্রতিফলন সেই কাজের অনুরুপ; কিংবা আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। যে ব্যক্তি আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে একহাত এগিয়ে আসি। আর যে ব্যক্তি আমার প্রতি একহাত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে দুই হাত এগিয়ে আসি। যে আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে ছুটে আসি। যে ব্যক্তি পৃথিবী সমান গুনাহ করে এবং আমার সঙ্গে কাউকে শরীক করা থেকে বিরত থাকে, আমি তার জন্য পৃথিবী সমপরিমাণ মাগফিরাত নিয়ে উপস্থিত হই।” মুসলিমঃ ৬৫৮৯

যে ব্যাপারটা আপনাকে আল্লাহর ব্যাপারে আরও বেশি লজ্জায় ফেলে দেবে তা হলো, আপনি কিন্তু আল্লাহ তাআলার কোন উপকার করতে সক্ষম নন। আল্লাহর এসব দানের প্রতিদান দেওয়াও আপনার পক্ষে অসম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আল্লাহ তাআলাই আপনাকে নেককর্ম করার তাওফিক দিয়েছেন। নেককাজ করার ইচ্ছা যদিও আপনি করেছেন, ঠিক আছে। কিন্তু এই নেককাজ করার সক্ষমতা আল্লাহ তাআলাই আপনাকে দিয়েছেন। আবার সেই নেককাজ করার কারণে তিনিই আপনাকে প্রতিদান দিচ্ছেন। যখন আল্লাহ তাআলা আপনাকে পরীক্ষায় ফেলেন এবং সবর করার তাওফিক দান করেন, তখন সেই সবরের কারণে আবার তিনিই আপনাকে প্রতিদান দিয়ে থাকেন। চাই সেটা অন্তরের প্রশান্তির মাধ্যমে হোক বা অন্য কোন মাধ্যমে। এগুলোকে আপনি কি বলবেন? এগুলোই হচ্ছে আল্লাহর “আল-ওয়াদুদ” নামের হাকীকত।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, বিপদে-আপদে এবং খশি-আনন্দে তাঁকে ভুলে যাব না। পরিস্থিতি যতই মারাত্মক হোক না কেন আমরা তাঁর কাছেই ছুটে যাব।  চলুন আমরা আল্লহকে ভালোবাসি।

লেখক: মাওলানা মোঃ মাকছুদুর রহমান

প্রভাষক (আরবি)

হাজিরহাট হামিদিয়া ফাযিল ডিগ্রি মাদরাসা