সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) জন্ম। দলটি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকেন্দ্রিক দ্বিদলীয় বৃত্তের বাইরে বিকল্প শক্তি গড়ার চেষ্টা করে আসছে। ২০২২ সালের দ্বাদশ কংগ্রেসেও বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে নেতারা তারুণ্যনির্ভর নেতৃত্ব ঘোষণা দেন।
এরই মধ্যে কমিটি দুই বছর পার করেছে। তাদের নেতৃত্বে লক্ষ্য পূরণে কতটুকু এগিয়েছে সিপিবি, কতটা জনসমর্থন পেয়েছে তাদের আদর্শ ও লড়াই-সংগ্রাম– এমন প্রশ্নে দলটির নেতাকর্মীই বলছেন, বাস্তবতা অস্বীকারের উপায় নেই। সাম্যবাদ ও বিকল্প গড়ার লড়াই-সংগ্রামের সফলতা সুদূর পরাহত। উল্টো অভ্যন্তরীণ মতভেদ বেড়েছে। বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে ‘দল কুক্ষিগত’ করার। এরই জেরে সম্প্রতি প্রবীণ নেতা ও সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান খানকে উপদেষ্টা পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এমন অবস্থায় আজ বুধবার সিপিবি ৭৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করবে। কেন্দ্রীয়ভাবে সকালে রাজধানীর পুরানা পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় মুক্তি ভবনে দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং বিকেল ৪টায় সমাবেশ ও লাল পতাকা মিছিল করবেন নেতাকর্মীরা। দেশজুড়ে একই কর্মসূচি পালন করা হবে।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ কলকাতা সম্মেলনে গঠিত হয় পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি। একই সম্মেলনে খোকা রায়কে সম্পাদক করে কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ববাংলা আঞ্চলিক কমিটি বা পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটি গঠন করা হয়। স্বাধীনতার পর এটিই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) নাম নেয়।
অবশ্য এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যাত্রা সিপিবি প্রতিষ্ঠারও প্রায় তিন দশক আগে, ১৯২০ সালে। তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী দলটির কর্মীদের ওপর হত্যা-নির্যাতন ও হুলিয়ার খড়্গ চালায়। হাজারো নেতাকর্মী দেশত্যাগে বাধ্য হন। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহীর খাপড়া জেলে কমিউনিস্ট রাজবন্দিদের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়ে সাত কমরেডকে শহীদ করে, যা এ ভূখণ্ডের প্রথম জেলহত্যা। প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্টরা গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। তারা তেভাগা, নানকার, টংকসহ নানা কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের পাশাপাশি ছাত্র ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংঘটিত করেন। ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই, জাতীয় সম্পদ রক্ষা, যুদ্ধাপরাধী ও যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিসহ সব আন্দোলনেই সিপিবি অনন্য ভূমিকা রেখেছে।
কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা সিপিবির সাবেক সভাপতি কমরেড মণি সিংহ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। নিয়মিত বাহিনীর বাইরেও ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে যৌথ গেরিলা বাহিনী গঠন করে সিপিবি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সিপিবি রাজপথে প্রতিবাদ করে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। সিপিবিকেও বেআইনি ঘোষণা করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় অর্ধেক সময় দলটি বেআইনি ছিল। এমনকি স্বাধীন দেশেও সিপিবিকে একাধিকবার বেআইনি হতে হয়েছে। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে সিপিবির অসংখ্য নেতাকর্মী জীবন দিয়েছেন। সর্বশেষ ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে সিপিবির মহাসমাবেশে বোমা হামলা হলে পাঁচ নেতাকর্মী শহীদ হন।
দীর্ঘ যাত্রাপথে সিপিবি কয়েক দফা ভাঙনের কবলে পড়েছে। দলটির অসংখ্য নেতা বিভিন্ন দলে যোগ দিয়েছেন। স্বাধীনতার আগে ও পরে ১৯৯১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত সিপিবি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে ছিল। পরে বিভিন্ন সময়ে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, ১১ দলসহ নানা গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল জোটে শামিল হয়। বর্তমানে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প বলয় গড়ে তোলার লক্ষ্যে সিপিবি বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিক হিসেবে কাজ করছে।
এদিকে স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় সব নির্বাচনে অংশ নিলেও সিপিবিসহ অন্যান্য বামপন্থি দলের সমন্বয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোট ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এবং সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বর্জন করে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার সিপিবির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এক বিবৃতিতে নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ীসহ দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।